শ্রম আইন (Labour Law)
শ্রম আইন হলো একটি দেশের এমন আইন বা বিধানসমূহের সমষ্টি যা কর্মক্ষেত্রে শ্রমিক এবং মালিকপক্ষের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করে। এটি শ্রমিকদের অধিকার, কর্মপরিবেশ, মজুরি, ছুটি, নিরাপত্তা, ক্ষতিপূরণ এবং অন্যান্য বিষয়গুলো সুনিশ্চিত করার জন্য প্রণীত হয়। শ্রম আইন সাধারণত শিল্প, কলকারখানা, প্রতিষ্ঠান এবং কর্মস্থলে শ্রমিকদের কল্যাণ এবং তাদের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করার জন্য কার্যকর করা হয়।
বাংলাদেশে প্রচলিত বিদ্যমান বিধিবদ্ধ কোন আইনে বা বিধিতে শ্রম আইনের সুনির্দিষ্ট কোন সংজ্ঞা দেয়া হয়নি। তবে শ্রম আইনের প্রকৃতি ও উদ্দেশ্য পর্যালোচনা করে উহার একটি যথাযথ ও গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা দেয়া যেতে পারে। শিল্পে শান্তি রক্ষার জন্য স্বীকৃত যে সব রাষ্ট্রীয় বিধি বা প্রথার মাধ্যমে মালিক শ্রমিক সম্পর্ক নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে তাকেই 'শ্রম আইন' বলা যেতে পারে।
সাধারণত কলকারখানা এবং অন্যান্য শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে শ্রমিকদের কার্যাবলী নিয়ন্ত্রণ করার জন্য এবং শ্রমিক ও মালিকদের বা নিয়োগকর্তাদের মধ্যে সম্পর্কের উন্নতি সাধনের জন্য যে আইন বিধিবদ্ধ ও প্রবর্তিত হয়েছে উহাকে শ্রম আইন বলে অভিহিত করা হয়।
অন্য কথায় বলা যায় যে, কলকারখানায়, দোকান ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান কিংবা শিল্প প্রতিষ্ঠানে উৎপাদনের উদ্দেশ্যে শ্রমিকদের নিয়োগ করা হয়। সুতরাং শিল্প ও উৎপাদন কার্যে নিয়োজিত শ্রমিকদের নিযুক্তি, নিযুক্তির শর্ত, কাজের পরিবেশ, মজুরী পরিশোধ, ক্ষতিপূরণ প্রদান, শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয় নিয়ন্ত্রণ করার জন্য রাষ্ট্রকর্তৃক যে সকল বিধান ও নিয়মাবলী প্রণীত হয়েছে উহাকেই শ্রম আইন বলা হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, নিয়োগকর্তা বা মালিকগণের শোষণের হাত হতে শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যেই প্রধানতঃ শ্রম আইন প্রণীত হয়েছে।
যে আইন সামগ্রিকভাবে দেশের শ্রমিক এবং শিল্পোন্নয়নের স্বার্থে প্রণয়ন করা হয় উহাকেই শ্রম আইন বলা হয়। শিল্পে বা কলকারখানায় শ্রমিকদের নিযুক্তিকে কেন্দ্র করেই শ্রম আইনের উৎপত্তি ও বিকাশ ঘটেছে। শিল্প কারখানাগুলি যদি শ্রমিক ছাড়াই চলতে পারত, তবে শ্রম আইনের কোনই প্রয়োজন হত না। কারখানা এবং শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে নিযুক্ত শ্রমিকদের নানাবিধ সমস্যা দূরীকরণের সুমহান উদ্দেশ্যেই শ্রম আইনের উৎপত্তি ঘটেছে।
শ্রম আইনের ঐতিহাসিক উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ (Historical Origin and Development of Labour Law)
শ্রম আইনের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশের ইতিহাস মানব সভ্যতার উন্নয়নের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। এটি মূলত শিল্প বিপ্লবের সময় থেকে বিকশিত হতে শুরু করে, যখন বৃহৎ শিল্প ও কলকারখানা গড়ে ওঠে এবং শ্রমিকদের শোষণ ও অমানবিক কর্মপরিবেশ নজরে আসে। নিচে শ্রম আইনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও ক্রমবিকাশ ধাপে ধাপে তুলে ধরা হলো:
১. প্রাচীন যুগে শ্রম সম্পর্ক
প্রাচীনকালে শ্রমিক ও মালিকের সম্পর্ক প্রধানত দাসত্ব এবং বশ্যতার উপর নির্ভরশীল ছিল। মিশর, গ্রিস এবং রোমান সভ্যতায় দাসদের মাধ্যমে কাজ করানো হতো। সেখানে শ্রমিকদের কোনো অধিকার ছিল না। ধর্মীয় নীতিমালা (যেমন: হিন্দুধর্মের মনুসংহিতা, ইসলামি শরিয়া আইন) কর্ম ও শ্রম সম্পর্কে কিছু বিধান উল্লেখ করেছিল, যা শ্রমিকদের সীমিত সুরক্ষা দিত।
২. মধ্যযুগে শ্রম সম্পর্ক
মধ্যযুগে শ্রমিকরা সাধারণত কৃষিক্ষেত্রে কাজ করত এবং জমিদারদের সাথে নির্দিষ্ট চুক্তির ভিত্তিতে কাজ করত। ইউরোপে গিল্ড সিস্টেম (Guild System)চালু হয়, যা শ্রমিকদের কাজের মান এবং তাদের অধিকার নিশ্চিত করার কিছু চেষ্টা করে। তবে এটি অধিকাংশ ক্ষেত্রে কারিগর এবং দক্ষ শ্রমিকদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিল।
৩. শিল্প বিপ্লবের যুগ (১৮শ শতক)
১৮শ শতকে ইউরোপে শিল্প বিপ্লব শুরু হয়। কলকারখানার সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে শ্রমিকদের চাহিদা বেড়ে যায়। তবে এই সময়ে শ্রমিকদের কঠিন কর্মপরিবেশ, দীর্ঘ কর্মঘণ্টা (১২-১৬ ঘণ্টা), কম মজুরি এবং শিশু ও নারী শ্রমিকদের শোষণ ব্যাপক ছিল। এই পরিস্থিতি শ্রমিকদের দুর্দশার প্রতিকার করতে শ্রম আইন প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা তৈরি করে।
৪. প্রথম শ্রম আইন (১৮শ ও ১৯শ শতক)
১৮০২ সালে যুক্তরাজ্যে "Health and Morals of Apprentices Act" প্রণীত হয়, যা শ্রম আইনের প্রথম প্রাথমিক রূপ। এটি শিশু শ্রমিকদের কাজের সময়সীমা নির্ধারণ করে। ১৮৩৩ সালে Factory Act প্রণীত হয়, যা শিশু শ্রমিকদের সুরক্ষা এবং কাজের সময়সীমা নির্ধারণ করে। ১৮৪২ সালে মাইন আইন (Mines Act) প্রণীত হয়, যা নারীদের এবং শিশুদের খনিতে কাজ করা নিষিদ্ধ করে। এই সময়ে শ্রমিক সংগঠন (Trade Union) গঠনের আন্দোলন শুরু হয়।
৫. উনিশ শতকে শ্রম আইনের প্রসার
উনিশ শতকে শ্রমিকদের অধিকারের জন্য আন্দোলন এবং শ্রমিক সংগঠন গঠনের প্রচেষ্টা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পায়। এই সময়ে কর্মঘণ্টা কমানোর আইন প্রণীত হয়; সাপ্তাহিক ছুটি এবং মাতৃত্বকালীন সুবিধা চালু হয় এবং বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি ব্যবস্থা (Arbitration System) চালু হয়।
৬. বিংশ শতকে শ্রম আইনের আধুনিকায়ন
International Labour Organization (ILO) ১৯১৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি বিশ্বব্যাপী শ্রমিকদের অধিকারের জন্য কাজ করে। শ্রমিকদের স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, ন্যায্য মজুরি, এবং কাজের শর্তাবলী উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন আন্তর্জাতিক কনভেনশন গৃহীত হয়। ১৯৪৮ সালে সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা (Universal Declaration of Human Rights) শ্রমিকদের অধিকারকে মানবাধিকারের অংশ হিসেবে ঘোষণা করে।
৭. ভারতীয় উপমহাদেশে শ্রম আইনের বিকাশ
ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনামলে শিল্প বিপ্লবের ফলে কলকারখানা গড়ে ওঠে। শ্রমিকদের জন্য কোনো সুরক্ষা ব্যবস্থা না থাকায় শোষণ ছিল ব্যাপক। ১৮৮১ সালে ব্রিটিশ সরকার Factories Act, 1881 প্রণয়ন করে, যা ভারতীয় শ্রমিকদের জন্য প্রথম শ্রম আইন। এতে শিশু শ্রমিকদের কাজের সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়। ১৯২৩ সালে Workers' Compensation Act চালু হয়, যা শ্রমিকদের দুর্ঘটনার ক্ষতিপূরণ দেয়ার বিধান করে। ১৯৪২ সালে Industrial Disputes Act প্রণীত হয়, যা শ্রম বিরোধ নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করে।
৮. বাংলাদেশের শ্রম আইনের বিকাশ
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর শ্রম আইন সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। ১৯৭২ সালে শ্রমিকদের জন্য বিভিন্ন সুবিধা নিশ্চিত করতে সংবিধানে শ্রমিকদের অধিকার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ২০০৬ সালে বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ প্রণয়ন করা হয়, যা বিভিন্ন আইনকে একত্রিত করে সমন্বিত রূপ দেয়।
বর্তমানে শ্রম আইন শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা এবং তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য একটি সমন্বিত কাঠামো প্রদান করে। বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬-এর মধ্যে স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, মজুরি, ছুটি, ট্রেড ইউনিয়ন এবং শ্রম বিরোধ নিষ্পত্তির মতো বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
শ্রম আইন মানব ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার এবং কল্যাণ নিশ্চিত করার জন্য গড়ে উঠেছে। এটি যুগে যুগে উন্নত হয়েছে এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় আন্দোলনের মাধ্যমে শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
0 Comments