বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি আইন(Intellectual Property Law)
বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি আইন বলতে এমন একটি আইনকে বোঝায় যা ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সৃজনশীল ও বৌদ্ধিক কাজের প্রতি আইনত সুরক্ষা প্রদান করে। এটি মূলত সাহিত্য, শিল্প, সংগীত, উদ্ভাবন, ব্র্যান্ড নাম, লোগো, এবং গোপন ব্যবসায়িক তথ্যের মতো কাজগুলোর জন্য নির্দিষ্ট সময়ের জন্য একচেটিয়া অধিকার দেয়।
বিশ্ব বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি সংস্থা (WIPO) এর মতে বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি হল মনুষ্য মস্তিষ্কের সৃষ্ট কাজ, যেমন উদ্ভাবন, সাহিত্যিক এবং শিল্পকর্ম, নকশা এবং ব্যবসায় ব্যবহৃত প্রতীক, নাম বা চিত্র। বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি আইন সৃষ্টিকারীদের তাদের সৃজনশীল অবদানের জন্য আইনগত অধিকার প্রদান করে।(intellectual property (IP) refers to creations of the mind, such as inventions; literary and artistic works; designs; and symbols, names, and images used in commerce. Intellectual property law provides legal rights to creators for their intellectual contributions.)
ট্রিপস চুক্তি (TRIPS Agreement) অনুযায়ী,’বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি অধিকার হল এমন অধিকার যা কোনো ব্যক্তি তাদের মস্তিষ্কের সৃষ্টির উপর পেয়ে থাকেন এবং যা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সৃষ্টিকারীকে একচেটিয়া অধিকার প্রদান করে।(Intellectual property rights are the rights given to persons over the creations of their minds. They usually give the creator an exclusive right over the use of his/her creation for a certain period of time.)
বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি আইন সৃজনশীলতার সুরক্ষার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ আইন। এটি সৃষ্টিকারীদের তাদের কাজের প্রতি ন্যায্য অধিকার প্রদান করে এবং সৃজনশীলতাকে উৎসাহিত করে।
বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি আইনের পটভূমি
বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি আইন(Intellectual Property Law) মানুষের সৃজনশীল কাজ এবং আবিষ্কারসমূহকে সুরক্ষিত রাখে। এই আইনের মাধ্যমে সৃজনশীল ব্যক্তিরা তাদের কাজের উপর নির্দিষ্ট সময়ের জন্য একচেটিয়া অধিকার পান। বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি আইন মূলত চারটি প্রধান শাখায় বিভক্ত:
ক) পেটেন্ট (Patent): এটি এমন একটি সুরক্ষা ব্যবস্থা যা নতুন আবিষ্কার বা উদ্ভাবনকে সুরক্ষিত করে। পেটেন্ট আবিষ্কারককে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য তার আবিষ্কারের উপর একচেটিয়া অধিকার প্রদান করে।
খ) ট্রেডমার্ক (Trademark): এটি কোনো ব্যবসার নাম, লোগো, স্লোগান বা প্রতীককে সুরক্ষিত করে যা একটি পণ্যের বা সেবার পরিচয় বহন করে।
গ) কপিরাইট (Copyright): এটি সাহিত্যিক, সঙ্গীত, চিত্রকলা, স্থাপত্য এবং চলচ্চিত্রের মতো সৃজনশীল কাজকে সুরক্ষিত রাখে।
ঘ) গোপনীয় তথ্য বা বাণিজ্যিক গোপনীয়তা (Trade Secret): এটি ব্যবসায়িক কৌশল, প্রক্রিয়া বা তথ্যকে সুরক্ষিত করে যা কোনো সংস্থার প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা প্রদান করে।
প্রাচীন যুগে বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি:
ক) প্রাচীন সভ্যতায় সৃজনশীল কাজ এবং উদ্ভাবনকে মৌখিক বা সামাজিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হতো।
খ) গ্রিক ও রোমান সভ্যতায় শিল্প, সাহিত্য এবং দর্শনের সৃষ্টিকর্তাদের সম্মান জানানো হতো।
গ) প্রাচীন চীনে বাণিজ্যিক গোপনীয়তা রক্ষা এবং মূল্যবান উদ্ভাবনের সুরক্ষার প্রচলন ছিল।
মধ্যযুগে বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি:
ক) মধ্যযুগে ইউরোপে শিল্পী এবং কারিগরদের কাজের সুরক্ষা নিশ্চিত করার প্রচেষ্টা শুরু হয়।
খ) ১৪৭৪ সালে ভেনিস প্রজাতন্ত্রে বিশ্বের প্রথম পেটেন্ট আইন কার্যকর হয়।
গ) বই মুদ্রণের প্রচলন এবং মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কারের ফলে কপিরাইটের গুরুত্ব বাড়তে শুরু করে।
আধুনিক যুগের বিকাশ:
১৭শ ও ১৮শ শতাব্দী:
ক) আধুনিক বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি আইন মূলত ইংল্যান্ডে ১৭১০ সালে স্ট্যাচুট অফ অ্যান (Statute of Anne) নামে কপিরাইট আইন প্রণয়নের মাধ্যমে শুরু হয়।
খ) পেটেন্ট এবং কপিরাইট আইনের মাধ্যমে সৃষ্টিকর্তা এবং উদ্ভাবকদের কাজের উপর একচেটিয়া অধিকার দেওয়া শুরু হয়।
আন্তর্জাতিক সুরক্ষার শুরু:
ক)১৮৮৩ সালে প্যারিস কনভেনশন পেটেন্ট এবং ট্রেডমার্কের আন্তর্জাতিক সুরক্ষার জন্য প্রণীত হয়।
খ)১৮৮৬ সালে বার্ন কনভেনশন আন্তর্জাতিক কপিরাইট সুরক্ষার জন্য চালু হয়।
আধুনিক আন্তর্জাতিক পটভূমি:
TRIPS চুক্তি:
ক) ১৯৯৫ সালে, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (WTO) আওতায় ট্রিপস চুক্তি (TRIPS Agreement) চালু হয়। এটি বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি সুরক্ষার জন্য সর্বজনীন মান নির্ধারণ করে।
খ) TRIPS চুক্তি অনুযায়ী, পেটেন্ট, কপিরাইট, ট্রেডমার্ক, ডিজাইন, এবং ট্রেড সিক্রেট সহ সব ধরণের বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি সুরক্ষার বিষয় অন্তর্ভুক্ত হয়।
WIPO (World Intellectual Property Organization):
ক) ১৯৬৭ সালে প্রতিষ্ঠিত WIPO বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি সুরক্ষার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সংস্থা।
খ) এটি ১৯৭০ সালে কার্যকর হয় এবং বর্তমানে ১৯৩টি সদস্য রাষ্ট্র নিয়ে কাজ করে।
বাংলাদেশে বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি আইনের প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশে বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি আইন (Intellectual Property Law) একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যা সৃজনশীলতা, উদ্ভাবন এবং ব্যবসায়িক পরিচিতির সুরক্ষা প্রদান করে। এই আইন দেশের বৌদ্ধিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখে। এর প্রেক্ষাপট মূলত ব্রিটিশ শাসনামল থেকে শুরু করে স্বাধীন বাংলাদেশের নিজস্ব আইনি কাঠামো পর্যন্ত বিস্তৃত।
১. ব্রিটিশ শাসনামলে সূচনা:
বাংলাদেশে বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি আইনের ভিত্তি ব্রিটিশ শাসনামলে প্রণীত হয়। ব্রিটিশরা ভারতবর্ষে তাদের শাসনকালে নিম্নলিখিত আইনি কাঠামো প্রবর্তন করেছিল:
পেটেন্ট ও ডিজাইন আইন, ১৯১১ (Patents and Designs Act, 1911):
ক) এই আইন পেটেন্ট ও ডিজাইনের সুরক্ষার জন্য প্রণীত হয়।
খ) এটি ছিল উপমহাদেশে প্রথম বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি সংক্রান্ত একটি সংগঠিত আইনি কাঠামো।
কপিরাইট আইন, ১৯১৪ (Copyright Act, 1914):
ক) সাহিত্য, সঙ্গীত এবং অন্যান্য শিল্পকর্মের সুরক্ষার জন্য এটি প্রণীত হয়।
খ) ব্রিটিশ শাসনের অধীনে প্রণীত এই আইন উপমহাদেশের সংস্কৃতি ও শিল্পের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
ট্রেডমার্ক সম্পর্কিত আইন:
- ব্যবসার পরিচিতি রক্ষা এবং প্রতিযোগিতামূলক বাজার সুরক্ষার জন্য ব্রিটিশরা ট্রেডমার্ক সুরক্ষার ব্যবস্থা করেছিল।
২. পাকিস্তান আমলে বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি আইন:
- পাকিস্তান আমলে ব্রিটিশ শাসনামলে প্রণীত আইনসমূহ কার্যকর ছিল।
- এই সময়ে নতুন কোনো বড় সংশোধনী বা আইন প্রণয়ন করা হয়নি।
৩. স্বাধীন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট:
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি আইনকে আধুনিক করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। দেশীয় প্রয়োজন ও আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী আইন সংশোধন এবং প্রণয়ন করা হয়েছে।
(ক) বিদ্যমান আইনি কাঠামো:
কপিরাইট আইন, ২০০০ (Copyright Act, 2000):
- এটি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম কপিরাইট আইন।
- সাহিত্য, সংগীত, শিল্পকর্ম, চলচ্চিত্র এবং সফটওয়্যারের মতো সৃজনশীল কাজের সুরক্ষার জন্য প্রণীত।
- এই আইন আন্তর্জাতিক কপিরাইট কনভেনশনগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
ট্রেডমার্ক আইন, ২০০৯ (Trademarks Act, 2009):
- ট্রেডমার্ক নিবন্ধন ও সুরক্ষার জন্য এই আইন প্রণয়ন করা হয়।
- এটি ব্র্যান্ড নাম, লোগো, এবং ব্যবসার পরিচিতি সুরক্ষিত রাখে।
পেটেন্ট ও ডিজাইন আইন:
- বর্তমানে বাংলাদেশ ১৯১১ সালের পেটেন্ট ও ডিজাইন আইন অনুসরণ করে।
- তবে, নতুন পেটেন্ট আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
(খ) প্রশাসনিক কাঠামো:
পেটেন্ট, ডিজাইন এবং ট্রেডমার্ক অধিদপ্তর (DPDT):
- এটি বাংলাদেশে বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি সুরক্ষার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি সংস্থা।
- DPDT পেটেন্ট, ডিজাইন, ট্রেডমার্ক, এবং কপিরাইট নিবন্ধন এবং সুরক্ষার কাজ পরিচালনা করে।
কপিরাইট অফিস:
- বাংলাদেশে কপিরাইট বিষয়ক নিবন্ধন এবং বিরোধ নিষ্পত্তির দায়িত্ব পালন করে।
৪. আন্তর্জাতিক অংশগ্রহণ:
বাংলাদেশ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চুক্তি এবং কনভেনশনে যোগ দিয়েছে যা দেশের বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি আইনকে আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী উন্নত করতে সহায়তা করেছে।
বিশ্ব বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি সংস্থা (WIPO):
- বাংলাদেশ ১৯৮৫ সালে WIPO-এর সদস্যপদ লাভ করে।
- WIPO-এর নীতিমালা অনুসরণ করে দেশের বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি আইন সংশোধন করা হয়েছে।
ট্রিপস চুক্তি (TRIPS Agreement):
- ১৯৯৫ সালে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (WTO) আওতায় TRIPS চুক্তিতে বাংলাদেশ অন্তর্ভুক্ত হয়।
- TRIPS চুক্তি অনুসারে, বাংলাদেশ ধীরে ধীরে তার বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি আইনের উন্নতি করছে।
বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি আইন সমাজে সৃজনশীলতা, উদ্ভাবন এবং শিল্পের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য। ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে এই আইন ধীরে ধীরে বিকশিত হয়েছে, যা আজ আন্তর্জাতিক এবং স্থানীয় পর্যায়ে একটি সুগঠিত কাঠামোতে পরিণত হয়েছে।
0 Comments