সর্বশেষ

6/recent/ticker-posts

বিচ্যুতির(Deviance) বলতে কি বুঝেন? বিচ্যুতির বৈশিষ্ট্যসহ এর কারণ আলোচনা করুন। অপরাধ ও বিচ্যুতির মধ্যে পার্থক্য তুলে ধরুন।

 

বিচ্যুতি ও অপরাধ কি?; বিচ্যুত আচরণ ও অপরাধমূলক আচরণের মধ্যে পার্থক্য?; বিচ্যুতি বলতে কি বুঝায়?; অপরাধ কত প্রকার ও কি কি?; অপরাধ ও বিচ্যুতির মধ্যে পার্থক্য; অপরাধ বিজ্ঞানের প্রকৃতি ও পরিধি; বাংলাদেশে অপরাধের ধরন ও প্রকৃতি; অপরাধের সংজ্ঞা; বিচ্যুত আচরণের কারণ; বিচ্যুতি আচরণ কি; বিচ্যুতি সম্পর্কিত সাদারল্যান্ডের তত্ত্বের নাম কি; অপরাধের কারণ সমূহ; What is a key difference between deviance and crime?; What is the difference between deviance and deviant?; What is a key difference between deviance and crime quizlet?; অপরাধ ও বিচ্যুতির মধ্যে পার্থক্য কি?; Difference between crime and deviance in sociology; Difference between crime and deviance with examples; Difference between crime and deviance pdf; Crime and deviance sociology PDF; Similarities between crime and deviance; Examples of crime and deviance; Crime and deviance criminology; what is the difference between crime and deviance? quizlet;


বিচ্যুতির(Deviance) বলতে কি বুঝেন?  বিচ্যুতির বৈশিষ্ট্যসহ এর কারণ আলোচনা করুন। অপরাধ ও বিচ্যুতির মধ্যে পার্থক্য তুলে ধরুন।



বিচ্যুত আচরণ সমাজ ব্যবস্থারই অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রতিটি সমাজে কোনো না কোনো ধরনের বিচ্যুত আচরণ লক্ষ করা যায়। সমাজে বসবাসকারী মানুষের মধ্যে মানসিক, শারীরিক ও বুদ্ধিগত পার্থক্য বিদ্যমান। সমাজবদ্ধভাবে বসবাস করতে গিয়ে মানুষ সাধারণত সামাজিক অনুশাসন মেনে চলে। কিন্তু ব্যক্তিস্বার্থে কিংবা প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে মানুষ অনেক সময় অপ্রত্যাশিত বা অবাঞ্ছিত কার্যকলাপে লিপ্ত হয়। এভাবেই সৃষ্টি হয় বিচ্যুত আচরণ। বিচ্যুত আচরণের জন্য আইনত শাস্তি বিধানের সুযোগ নেই। তবে অনেক সময় সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির প্রয়াস লক্ষ করা যায়। বিচ্যুত আচরণই একসময় ব্যক্তিকে বিপথগামী করে তোলে এবং সে অপরাধে লিপ্ত হয়। আবার যেহেতু প্রচলিত নিয়মনীতি ও মূল্যবোধ সমাজের প্রভুত্ব বিস্তারকারী শ্রেণি দ্বারা নির্ধারিত হয়, যেহেতু অন্যান্য শ্রেণির ব্যক্তিবর্গ এর বিরোধিতা করে ফলে বিচ্যুতি ও অপরাধ জন্ম হয়। 



বিচ্যুতির সংজ্ঞা(Definition of Deviance)


সমাজবদ্ধ জীবন-যাপনের পর থেকেই মানবগোষ্ঠীকে সমাজস্থ কিছু নিয়ম-কানুন এবং আদর্শের মানদণ্ডে পরিচালিত হতে হয়েছে। এই নিয়ম-কানুন ও আদর্শের ব্যত্যয় ঘটলে সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা বিঘ্নিত হয়, সমাজে নেমে আসে অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্ব। তাই এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন সমাজের প্রচলিত রীতি-নীতি ও আদর্শকে সমুন্নত রাখা। বস্তুত সমাজে প্রচলিত রীতি-নীতি, আদর্শ ও মূল্যবোধের পরিপন্থি আচরণই বিচ্যুতি। বিচ্যুতি হলো সমাজের স্বাভাবিক এবং বাঞ্ছিত আচরণের বিরোধী বা পরিপন্থি কোন কাজ।


ডেভিড পোপেনো (David Popenoe) এর মতে,বিচ্যুতি হলো এমন এক আচরণ যা কোন গোষ্ঠী বা সমাজের সামাজিক আদর্শকে ভঙ্গ করে।(Deviance is a behaviour that violates the social norms of a group or society."[Popenoe, David, Sociology, 1986; p. 580.] 


প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী আর. টি. শেফার (R. T. Schaefer) তাঁর 'Sociology' গ্রন্থে বলেছেন,বিচ্যুতি হলো সেই আচরণ যা কোন গোষ্ঠী বা সমাজের প্রত্যাশিত আচরণের মানকে ভঙ্গ করে।(Deviance is a behaviour that violates the standards of contact or expectations of a group or society. [Schaefer, R. T., Sociology, 1983; p. 537.] 



রস (Ross) এর মতে,অর্থাৎ, বিচ্যুতি আচরণ হলো সেই আচরণ যা সামাজিক প্রত্যাশাকে অনুমোদন করে না। (Deviant behaviour is that behaviour which does not confirm to social expectation.)


বি. ভূষণ (B. Bhushan) তাঁর 'Dictionary of Sociology' গ্রন্থে উল্লেখ করেন,বিচ্যুতি প্রত্যয়টি কোন আচরণকে বুঝাতে ব্যবহৃত হয় যা নিয়মাবলি বা অন্যের প্রত্যাশাকে লঙ্ঘন করে এবং যা অনুমোদিত বা শাস্তির প্রতি আকৃষ্ট করে।(The term 'deviance' is used to refer to behaviour which infringes rules or the expectations of others and which attracts disapproval or punishment.)[Bhusan, B. Dictionary of Sociology, 1989; p. 72.]



রবার্টসন (Robertson) এর মতে, বিচ্যুতি হলো এমন এক ধরনের আচরণ বা বৈশিষ্ট্য যা তাৎপর্যপূর্ণ প্রত্যাশিত সামাজিক মূল্যবোধকে ভঙ্গ করে এবং যা সমাজের বহু লোক নেতিবাচকভাবে মূল্যায়ন করে।(Deviance is a behaviour or characteristic that violates significant social norms and expectations and is negatively valued by large numbers of people in consequence.)[Robertson, Sociology, 1980; p. 529.]


উপর্যুক্ত সংজ্ঞাগুলোর আলোকে বলা যায়, বিচ্যুতি হলো সমাাজিক সংহতি ও শৃঙ্খলার পরিপন্থি কাজ। কোনো ব্যক্তি যখন সামাজিক রীতি-নীতি, আইন-কানুন ও আদর্শানুসারে কাজ করে না, তখন সে ব্যক্তিকে 'বিচ্যুত ব্যক্তি। সামাজিক রীতি-নীতি বিবেচনায় ঐ বিচ্যুত ব্যক্তির কার্যকলাপ ও আচরণ, অপ্রত্যাশিত ও নৈতিক আদর্শ পরিপন্থী। মাদকাসক্তি, নারীর প্রতি বিরূপ মনোভাব, সমকামিতা, গর্ভপাত, আত্মহত্যা, দুর্নীতি, প্রতারণা, ষড়যন্ত্র, সাম্প্রদায়িকতা প্রভৃতি বিচ্যুত আচরণ হিসেবে পরিগণিত।বস্তুত বিচ্যুত আচরণের জন্য প্রয়োজন জনসচেতনতা এবং সকলের সম্মিলিত প্রয়াস।




বিচ্যুতির বৈশিষ্ট্য(Characteristics of Deviance)


প্রত্যেক মানুষের কাছেই সমাজের প্রত্যাশা হলো সমাজের মূল্যবোধের অনুকূল আচরণ প্রদর্শন করা। কিন্তু ব্যক্তিমানুষ যখন ঐ মূল্যবোধ পরিপন্থি আচরণ প্রদর্শনে ব্যর্থ হয় তখনই তা বিচ্যুত আচরণ হিসেবে প্রতিভাত হয়। নিম্নে বিচ্যুত আচরণের বৈশিষ্ট্যগুলো উল্লেখ করা হলো:


১। বিচ্যুত আচরণ আচরণবিধি ও মূল্যবোধ পরিপন্থী;


২। বিচ্যুত আচরণ সামাজিকভাবে নিন্দনীয় হলেও আইনগতভাবে দণ্ডনীয় নয়; 


৩। আচরণের অস্বাভাবিক রূপ হচ্ছে বিচ্যুত আচরণ; 


৪। এটি সমাজের অপ্রত্যাশিত এবং অবাঞ্ছিত; 


৫। বিচ্যুত আচরণ ব্যক্তিগত, আদর্শগত এবং সামাজিকভাবে ক্ষতিকর; 


৬। বিচ্যুত আচরণ সামাজিক সংহতি ও স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করে; 


৭। বিচ্যুত আচরণ আপেক্ষিক। সময় ও সমাজভেদে এর মাত্রাগত পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। 


৮। বিচ্যুত আচরণ সামাজিক মিথস্ক্রিয়া এবং সামাজিকীকরণের ফল। এটি সামাজিক প্রপঞ্চও বটে। সমাজের বাইরে কোনো বিচ্যুতি নেই। 


৯। বিচ্যুত আচরণ সামাজিক কাঠামোর সাথে সম্পৃক্ত। যেমন- শিল্প সমাজে জ্ঞাতিত্ব বা প্রতিবেশীসুলভ সম্পর্ক খুব কমই বিকশিত হয়। কিন্তু গ্রামীণ সমাজে কেউ বিচ্ছিন্নভাবে বসবাস করতে চাইলে তা বিচ্যুত আচরণ বলে গণ্য করা হয়। 


১০। বিচ্যুত আচরণ কখনো কখনো সামাজিক পরিবর্তনে ভূমিকা রাখে। চিরায়ত নিয়ম-কানুন ও সামাজিক বিধিনিষেধের বাইরে গিয়ে ক্ষুদিরাম, সূর্যসেন, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রামমোহন রায় যেসব বিচ্যুত আচরণ করেছিলেন তা স্বাধীনতা ও সামাজিক সংস্কারকে ত্বরান্বিত করেছিল।



 বিচ্যুত আচরণের ধরনসমূহ (Types of Deviant Behaviour) 


সমাজে নানা ধরনের বিচ্যুত আচরণ পরিলক্ষিত হয়। যেমন Edwin Limert তাঁর 'Social Pathology' গ্রন্থে দু'ধরনের বিচ্যুত আচরণের উল্লেখ করেছেন। যথা: 

ক) মুখ্য বিচ্যুত আচরণ (Primary deviance) এবং 

খ) গৌণ বিচ্যুত আচরণ (Secondary deviance)। 


মৌলিক মূল্যবোধের পরিপন্থী আচরণ প্রদর্শন করলে তা মুখ্য বিচ্যুত আচরণ। যেমন: সংক্ষিপ্ত কাপড়ে মেয়েদের বাইরে চলাফেরা, শ্রেণিকক্ষের মধ্যে ধূমপান করা ইত্যাদি। অন্যদিকে পরিবর্তনশীল মূল্যবোধের পরিপন্থী আচরণ হচ্ছে গৌণ বিচ্যুতি। যেমন: বড়দের সালাম না দেয়া, জেব্রা ক্রসিং কিংবা ফুটওভারব্রিজ দিয়ে রাস্তা পারাপার না হওয়া, অশ্লীল ভাষা প্রয়োগ করা ইত্যাদি। 


বিচ্যুত আচরণের আরো কয়েকটি ধরন সম্পর্কে নিচে আলোচনা করা হল: 


১। আচরণের বিচ্যুতি (Deviance of behaviour): বিচ্যুতির ধরনের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে আচরণগত বিচ্যুতি। এ ধরনের বিচ্যুতির ফলেই সমাজের অধিকাংশ অপরাধ সংঘটিত হয়ে থাকে। জুয়াখেলা, সমকামিতা, পরকীয়া প্রেম, পতিতাবৃত্তি ইত্যাদি আচরণের বিচ্যুতি। 


২। অভ্যাসের বিচ্যুতি (Habitual deviance): অভ্যাসগত বিপথগামিতা অনেক সময় সামাজিক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। মাদকাসক্তি, জুয়াখেলা, নারীর প্রতি লোলুপ মনোভাব ব্যক্তিকে বেপরোয়া করে তুলতে পারে। 


৩। মনস্তাত্ত্বিক বিচ্যুতি (Psychological deviance): আচরণের মাধ্যমে মনস্তাত্ত্বিক বিচ্যুতির প্রকাশ ঘটে। অতিরিক্ত আবেগ মানুষকে উদাসীন, স্বার্থপর ও লোভী করে তোলে। ফলে সমাজে এর নেতিবাচক প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। 


৪। সাংস্কৃতিক বিচ্যুতি (Cultural deviance): সাংস্কৃতিক ক্ষমতাসম্পন্ন লোকদের এ ধরনের বিচ্যুতি পরিলক্ষিত হয়। সাংস্কৃতিকভাবে বিচ্যুত মানুষের কর্মকাণ্ড সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও শিল্পকলার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। সুতরাং সাংস্কৃতিক বিচ্যুতিও অনেক বিচ্যুত আচরণের বহিঃপ্রকাশ।



বিচ্যুতির কারণ(Causes of Deviance)


বিচ্যুতি হলো কোন সমাজ বা গোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠিত মূল্যবোধের পরিপন্থিমূলক কাজ বা আচরণ। বিচ্যুতিমূলক আচরণের জন্য সমাজ কাউকে বিপদগামী হিসেবে আখ্যায়িত করে কিংবা বিচ্যুতিমূলক আচরণকারী সমাজের ন্যায়-নীতি ও শৃঙ্খলার সাথে তাল মিলাতে না পেরে আরো বিপদগামী হয়ে পড়ে এবং অসামাজিক বা অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ প্রদর্শনে লিপ্ত হয়। কোন একটি নির্দিষ্ট কারণে বিচ্যুতি ঘটে না। এর পিছনে নানাবিধ কারণ রয়েছে। মনোচিকিৎসকগণ ও অপরাধবিজ্ঞানীরা এ ধরনের বিচ্যুতির কারণগুলোকে তিন ভাগে ভাগ করেছেন। যথা:


১. শারীরিক কারণ (Physical Causes),

২. মনস্তাত্ত্বিক কারণ (Psychological Causes) এবং

৩. সমাজ-সংস্কৃতিমূলক কারণ (Socio-Cultural Causes) ।


১. শারীরিক কারণ (Physical Causes)


কোন ব্যক্তির মধ্যে যখন শারীরিক ত্রুটি বা অসংগতি(বংশগতি, দৈহিক গঠনজনিত ত্রুটি, ক্রোমোজমের ত্রুটিজনিত বিকৃতি, জিনের ত্রুটিজনিত বিকৃতি, পরিবারের ইতিহাস বিশ্লেষণ ও যমজ সন্তান পর্যবেক্ষণ, শারীরিক অসুস্থতা, ক্লান্তি, ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহার) পরিলক্ষিত হলে সে সমাজের সাথে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারে না এবং সমাজের মূল্যবোধ পরিপন্থি কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে। 


২. মনস্তাত্ত্বিক কারণ (Psychological Causes)


মনস্তাত্ত্বিক কারণেও অনেকে বিচ্যুত আচরণ করে থাকে। দুর্বল চিত্তের লোকেরা সমাজের লোকদের সাথে অনেক সময় মেলামেশা করতে সংকোচবোধ করে এবং ধীরে ধীরে বিচ্যুতির দিকে ধাবিত হয়। অনেক সময় দেখা যায়, নানারকম রোগের ফলে মস্তিষ্ক বিকৃতি ও মানসিক অসাম্য ঘটে থাকে, ফলে সে অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ করে থাকে। তাছাড়া কোন পরিবারে যখন পারিবারিক কলহ চরম আকার ধারণ করে, ছেলে-মেয়েরা পিতা-মাতার স্নেহ থেকে বঞ্চিত হয় তখন মানসিক বৈকল্য দেখা দেয়। ফলে কারণে-অকারণে তার মেজাজ রুক্ষ্ম হয় এবং বিচ্যুত আচরণ করতে দ্বিধাবোধ করে না। মনস্তাত্ত্বিক কারণের জন্য নিম্নোক্ত উপাদানগুলো; যেমন- পিতা-মাতার আদর-স্নেহের বঞ্চনা, পারিপার্শ্বিক অবস্থা থেকে বঞ্চনা, ভঙ্গুর পারিবারিক কাঠামো, ত্রুটিপূর্ণ ব্যক্তিত্বের বিকাশ, সামাজিক দ্বন্দ্ব-কলহ, যুদ্ধ-সংঘাত, হতাশা, চাপ ও ব্যর্থতা, অক্ষমতা, বিকলতা, অশান্তি এবং অপরিপক্বতা ইত্যাদি দায়ী।


৩. সমাজ-সংস্কৃতিমূলক কারণ (Socio-Cultural Causes)


মানুষ সামাজিক জীব। সুতরাং সমাজবদ্ধ জীব হিসেবে তাকে সমাজস্থ নিয়ম-কানুন, আদর্শ- মূল্যবোধ ও বিধি-নিষেধ মেনে চলতে হয় এবং সমাজের সাথে তাল মিলাতে গিয়ে সংস্কৃতি ও সভ্যতার উপাদানগুলো তাকে আত্মস্থ করতে হয়। এর মধ্য দিয়েই সে নিজেকে উপস্থাপন করে এবং সমাজের পূর্ণাঙ্গ সদস্য হিসেবে সমাজ আকাঙ্ক্ষিত ধারায় বেড়ে উঠে। কিন্তু নানাবিধ কারণে এর ব্যত্যয় ঘটলে ব্যক্তির মধ্যে তখন বিচ্যুতিমূলক আচরণ পরিলক্ষিত হয়। বিচ্যুতির সমাজ-সংস্কৃতিমূলক কারণগুলোর মূল উপাদানগুলো হলো: দ্বান্দ্বিকতা, সম্পদের অসম বণ্টন, দুর্নীতি, জালিয়াতি, কর্মসংস্থানের অভাব, অপসংস্কৃতি, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, সাম্প্রদায়িকতা, ভাষাগত ও জাতিগত দ্বন্দ্ব ইত্যাদি। পরিশেষে বলা যায়, সমাজের আদর্শ ও মূল্যবোধ, রীতি-নীতি, ঐতিহ্য ইত্যাদির মাপকাঠিতে যেসব কাজ বা আচরণ অনাকাঙ্ক্ষিত এবং অসমর্থিত তাই হলো বিচ্যুতি এবং এই বিচ্যুতির জন্য কোন একটি নির্দিষ্ট কারণ এককভাবে দায়ী নয়।


অপরাধ ও বিচ্যুতির মধ্যে পার্থক্য(Difference between Crime and Deviance)


সমাজ বা রাষ্ট্রের আইন ভঙ্গমূলক কাজই অপরাধ হিসেবে বিবেচিত। অপরাধমূলক কাজের জন্য শাস্তির বিধান রয়েছে। অন্যদিকে, সামাজিক আদর্শ ও মূল্যবোধ পরিপন্থি কাজগুলো বিচ্যুতি হিসেবে বিবেচিত এবং এই কাজের জন্য সমাজস্থ মানুষ বিচ্যুত আচরণকারীকে নেতিবাচকভাবে মূল্যায়ন করে। নিম্নে অপরাধ ও বিচ্যুতির মধ্যকার পার্থক্যগুলো তুলে ধরা হলো—




বিচ্যুতি(Deviance)

অপরাধ(Crime)

১. সমাজে এমন অনেক কাজ ও আচরণ লক্ষ্য করা যায় যা আইনে নিষিদ্ধ না হলেও সেসব সমাজের পরিপন্থি যাকে বিচ্যুতি বলা যায়।

১.আইন ভঙ্গমূলক কাজই অপরাধ। কোন রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ বা সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ কাজ বা আচরণ প্রদর্শন করলে তা অপরাধ বলে গণ্য হয়। 

২. অপরাধের প্রাথমিক স্তর হচ্ছে বিচ্যুতি। 

২.বিচ্যুতির চূড়ান্ত রূপ হচ্ছে অপরাধ।


৩. বিচ্যুত আচরণ নিয়ন্ত্রণে পরিবার এবং সমাজের  ভূমিকাই যথেষ্ট।

৩. অপরাধ নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্রের ভূমিকা অধিকতর কার্যকর। তবে সামাজিক আন্দোলন এবং সচেতনতাও প্রয়োজন।

৪. বিচ্যুতি সামাজিক শৃঙ্খলাকে দুর্বল করে। 


৪. অপরাধ রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলাকে দুর্বল ও ক্ষতিগ্রস্থ করে।

৫. বিচ্যুত আচরণের নির্ধারক হচ্ছে পরিবার, গোষ্ঠী বা সমাজ।  ।

৫. অপরাধের নির্ধারক হচ্ছে আইন, সরকার বা রাষ্ট্র

৬. বিচ্যুত আচরণকারীকে থানা-পুলিশ, আইন-আদালত মোকাবিলা করতে হয় না। 

৬. কিন্তু অপরাধীকে থানা-পুলিশ, আইন-আদালত মোকাবিলা করতে হয়।

৭.সামাজিক মূল্যবোধের পরিপন্থি কাজ বা আচরণ বিচ্যুতির পর্যায়ে পড়ে।

৭. অন্যদিকে, আইনবিরোধী বা আইন ভঙ্গমূলক কাজ অপরাধের আওতায় পড়ে। 

৮. যতই সামাজিক পরিবর্তন ঘটুক না কেন অপরাধ সবসময় বিচ্যুতিমূলক আচরণের মধ্যে পড়ে।

৮. সামাজিক বিচ্যুতিমূলক আচরণের কোন কোন দিক কখনো কখনো অপরাধমূলক আচরণে পরিণত হতে পারে।

৯. সব সামাজিক বিচ্যুতিমূলক আচরণ অপরাধ নয়।

৯. কিন্তু সব অপরাধই সামাজিক বিচ্যুতিমূলক আচরণ। 

১০. বিচ্যুতিমূলক আচরণের জন্য শাস্তি নির্ধারিত নয়।

১০.  অন্যদিকে, অপরাধমূলক আচরণের জন্য শাস্তির বিধান রয়েছে ।

১১. সমাজের ঐতিহ্য ও মূল্যবোধ বিরোধী কাজই হলো বিচ্যুতি।

১১. অপরদিকে, কোন কাজ আইন দ্বারা নিষিদ্ধ হলে অথবা আইন অনুসারে নির্ধারিত কর্তব্যে অবহেলা হলে তা অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। 

১২.  বিচ্যুতিমূলক আচরণ নিয়ন্ত্রণ করা অপরাধ থেকে অনেক সহজ।

১২.  অপরাধ সাধারণত অনানুষ্ঠানিক কোন বাহন বা সংস্থা দ্বারা সুষ্ঠুভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না, 

১৩. বিচ্যুতি আচরণে তুলনামূলক ক্ষতির পরিমাণ বেশি।

১৩. কিন্তু অপরাধ সমাজের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করতে পারে। 

১৪. বিচ্যুতিমূলক আচরণ করতে সাধারণ জনগণ তেমন ভীত হয় না।

১৪. অন্যদিকে, অপরাধমূলক কাজ করতে সাধারণ জনগণ ভয় করে। 

১৫. বিচ্যুত আচরণের কোন পরিকল্পনার প্রয়োজন হয় না।

১৫. কিন্তু অপরাধমূলক কাজ ব্যক্তি পরিকল্পিতভাবে করে থাকে। 

১৬. সমাজ ও সংস্কৃতিভেদে বিচ্যুত আচরণে পার্থক্য  দেখা যায়। একসমাজে যা বিচ্যুতি, অন্য সমাজে তা বিচ্যুতি না ও হতে পারে।

১৬. অধিকাংশ ক্ষেত্রে সব সমাজ ও সংস্কৃতিতে অপরাধের ক্ষেত্রে তেমন পার্থক্য থাকে না। হত্যা, ধর্ষণ, চুরি সর্বত্রই অপরাধ হিসেবে গণ্য। তবে দেশভেদে শাস্তির পার্থক্য রয়েছে। একই অপরাধে কোনো দেশ অপরাধীর মৃত্যুদণ্ড দিতে পারে আবার কোনো কোনো দেশ নির্দিষ্ট মেয়াদে কারাদণ্ড দিতে পারে।


মোটকথা, বিচ্যুত আচরণ ও অপরাধের মধ্যে মাত্রাগত পার্থক্য রয়েছে। বিচ্যুতির জন্য আইনগতভাবে শাস্তির বিধান নেই। অন্যদিকে অপরাধ হচ্ছে আইনের লঙ্ঘন এবং শাস্তিযোগ্য। মূল্যবোধের অবক্ষয় বিচ্যুতি এবং অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে। মাদকাসক্তি, নারীর প্রতি সহিংসতা, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজী, ঘুষ-দুর্নীতি ইত্যাদির মূলে রয়েছে নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়। ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি, ধর্ম ও নৈতিকতার চর্চা বিচ্যুত আচরণ ও অপরাধের কার্যকর প্রতিষেধক হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।



পরিশেষে বলা যায় যে, অপরাধ ও বিচ্যুতির মধ্যে পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও উভয়ই সমাজের নিয়ম-নীতি ও মূল্যবোধ পরিপন্থি কাজ। উভয়ের দ্বারা সমাজস্থ মানুষ ক্ষতির সম্মুখীন হয়।


তথ্যসূত্র- ১। বিচ্যুতি ও অপরাধ — ড. এ এম এম শওকত আলী এবং মোঃ ওবায়দুর রহমান ২। বিচ্যুতি ও অপরাধ— ড. মাহমুদ-উল-আলা, অরূপ বন্ধু দাম এবং দীনা ফারজানা। ৩। ইন্টারনেটের বিভিন্ন সাইট



Post a Comment

0 Comments