সর্বশেষ

6/recent/ticker-posts

অপরাধ বিজ্ঞান (Criminology in details)




অপরাধ বিজ্ঞান
(Criminology)

অপরাধ বিজ্ঞান
(Definition of Criminology)

অপরাধ বিজ্ঞানকে স্বয়ংসম্পূর্ণ বিজ্ঞান বলা যায় কি-না সে বিষয়ে অনেক মতভেদ আছে। অপরাধ বিজ্ঞানে অপরাধ ও অপরাধীর বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে আলোচনা করা হয় বলেই অপরাধ বিজ্ঞানকে বিজ্ঞান বলা হয়, এবং আরো বলা যেতে পারে। বিভিন্ন বিজ্ঞানপুষ্ট ইহা একটি বিশেষ বিজ্ঞান। যেমন– এই বিজ্ঞানকে সাহায্য করে ক্রিমিন্যাল বায়োলজি, ক্রিমিন্যাল সোসিওলজি, ক্রিমিন্যাল সাইকোলজি, ফরেনসিক মেডিসিন, সাইনটিফিক পুলিস মেথড, জুডিশিয়াল সাইকোলজি এবং অন্যান্য ব্যবহারিক বিজ্ঞানসমূহ।


কোন কাজকে যখনই অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয় অবশ্যই সেখানে শাস্তির বিধান থাকতে হবে। সুতরাং কোন ব্যক্তিকে শাস্তি দেয়ার পূর্বে তার অপরাধের সত্যতা নির্ধারণের জন্য বিশেষ বিশেষ পদ্ধতি অবলম্বন করা হয় এবং এই সকল পদ্ধতিকে সাফল্য মণ্ডিত করতে অপরাধ বিজ্ঞান বিশেষভাবে সাহায্য করে; যেমন-


(১) অপরাধ ও অপরাধীর সংজ্ঞা ও উহার শ্রেণীবিভাগ;

(২) মানুষের অপরাধপ্রবণতা ও তাদের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ;

(৩) অপরাধীগণের ব্যবহৃত পদ্ধতি ও কৌশল এবং এর সত্য উদঘাটন ব্যবহারিক ও বৈজ্ঞানিক আইনমাফিক প্রচেষ্টা এবং অপরাধ দমনের বিভিন্ন ভূমিকার বিশ্লেষণ।


পৃথিবীর সকল প্রাণীগণের মধ্যে মানুষই সর্ববিষয়ে শ্রেষ্ঠ এবং এই মানুষের আচরণের ও কার্যাবলী দ্বারাই অপরাধ জগতের সৃষ্টি। মানুষের আচরণ খুবই জটিল। এ জটিল সমস্যা নিয়ে সমাজ বিজ্ঞানীকে তাঁর মতামত ব্যক্ত করতে হয়। প্রধান ও বিশেষ অসুবিধা হল মানুষের আচরণকে গবেষণাগারে আবদ্ধ রেখে পরীক্ষা নিরীক্ষা করা সম্ভব নয়। সুতরাং অপরাধের ঘটনাপ্রবাহ, অপরাধীর ব্যবহৃত কলাকৌশল, কার্যপ্রণালী, বিভিন্ন সূত্র ও চিহ্নাদির বিশ্লেষণ, আচরণ এবং অবশেষে বিভিন্ন সাক্ষ্য প্রমাণাদির বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে অপরাধের সত্য উদঘাটন সম্ভব হয় এবং অপরাধ বিজ্ঞানই এর একমাত্র সহায়ক।


অপরাধ বিজ্ঞান কাকে বলে?

 [What is Criminology?]


অপরাধবিজ্ঞানের ইংরেজি প্রতিশব্দ 'Criminology' শব্দটি যৌথভাবে ল্যাটিন শব্দ ‘crimen(accusation) এবং গ্রীক শব্দ 'logia'’ থেকে এসেছে। শাব্দিক অর্থে অপরাধবিজ্ঞান হচ্ছে অপরাধ সম্বন্ধীয় জ্ঞান বা বিজ্ঞান। ফরাসি নৃবিজ্ঞানী Paul Topinard ১৮৭৯ সালে সর্বপ্রথম ফরাসি ভাষায় 'Criminologie' প্রত্যয়টি ব্যবহার করেন। তবে আমেরিকায় সর্বপ্রথম ১৯২০ সালে 'Criminology' শিরোনামে গ্রন্থ রচনা করেন সমাজবিজ্ঞানী Maurice Parmalee. আবার Raffaele Garofalo কেও 'Criminology' (১৮৮৫) এই শব্দটি ব্যবহারের প্রথম ব্যক্তি বলে মনে করা হয়।'বিখ্যাত ইতালিয় জুরিস্ট, আইনজীবী, রাজনীতিজ্ঞ, দার্শনিক সিজার মার্কিস বেকারিয়া(Cesare Bonesana di Beccaria) আধুনিক অপরাধ বিজ্ঞানের জনক(Father of Modern Criminology)।


যে বিজ্ঞান পাঠ করলে অপরাধ, অপরাধ জগৎ, অপরাধী এবং অপরাধীর মনত্ত্ব আচার-ব্যবহার, কৌশল, কার্য-প্রণালী, অপরাধীর ব্যবহৃত ও পরিত্যক্ত সূত্র ও চিহ্নাদির বিশ্লেষণ, সাক্ষী ও সাক্ষ্য গ্রহণ পদ্ধতি প্রভৃতি বিষয় অবগত হওয়া যায় এবং যে জ্ঞান অপরাধ দমনে সহায়ক হয় তাকে অপরাধ বিজ্ঞান(Criminology) বলে।

সাধারণত যে বিজ্ঞানে অপরাধ ও অপরাধীদের সম্পর্কে বিজ্ঞান সম্মত আলোচনা করা হয় তাকে অপরাধ বিজ্ঞান বলে। মৌখিক সাক্ষীর উপর নির্ভরশীল না হয়ে বিজ্ঞান ভিত্তিক পদ্ধতিতে অপরাধের ধরন ও অপরাধী শনাক্তকরণকে অপরাধ বিজ্ঞান বলা হয়ে থাকে। ব্যাপক অর্থে অপরাধ বিজ্ঞান বলতে বুঝাবে, আইন ভঙ্গকারী অপরাধীর চরিত্র সংশোধন, তাদের সমাজে পুনর্বাসন এবং অপরাধীর মন থেকে অপরাধ প্রবণতা হ্রাস করার প্রচেষ্টা, অপরাধ বিষয়ক আইনের প্রকৃতি তার প্রয়োগ কোন কোন অপরাধ সংঘটিত হয়ে থাকে ইত্যাদি বিষয় নিয়ে অনুসন্ধান ও গবেষণা।


এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট অপরাধবিজ্ঞানী Edwin Sutherland তাঁর 'Principles of Criminology' গ্রন্থে বলেন, "Criminology is the study of crime and social phenomena." তিনি মনে করেন, সামাজিক প্রপঞ্চ হিসেবে অপরাধ এবং কিশোর অপরাধ সম্পর্কিত জ্ঞান ভাণ্ডার হচ্ছে অপরাধবিজ্ঞান। এই বিজ্ঞান তার বিষয়বস্তু আলোচনায় আইন প্রণয়ন, আইন ভঙ্গ এবং আইন ভঙ্গের প্রতি মানুষের প্রতিক্রিয়াসমূহ অন্তর্ভুক্ত করে।


আবার Martin Roy Haskell and Lewis Yablonsky তাঁদের 'Crime and Delinquency' গ্রন্থে বলেন,অপরাধবিজ্ঞান হচ্ছে অপরাধ এবং অপরাধী সম্পর্কে বিজ্ঞানভিত্তিক অধ্যয়ন।(Criminology is the scientific study of crime and criminals)


পরিশেষে বলা যায় যে, অপরাধবিজ্ঞান হলো সামাজিক বিষয় হিসেবে অপরাধের বিজ্ঞানসম্মত অধ্যয়ন" অথবা "এটা এমন এক বিজ্ঞান যা মানুষের এমন সব আচরণগত দিক নিয়ে আলোচনা করে যেগুলো অপরাধ আইন ভঙ্গ করে।" ব্যাপক অর্থে বলা যায়, অপরাধের কারণ এবং দমন, শান্তি, অপরাধীদের শুদ্ধিকরণ এবং অপরাধীদের শুদ্ধিকরণে নিয়োজিত এবং সংস্থাসমূহ সম্পর্কিত বিদ্যার সকল শাখা। আরেকটি সংজ্ঞা মতে বলা যায়, অপরাধীদের আচরণ সম্পর্কে অনুসন্ধান, অপরাধীদের সামাজিক প্রভাব, অপরাধের নিয়ন্ত্রণ এবং অপরাধীদের শুদ্ধিকরণ নিয়ে যে জ্ঞান-বিজ্ঞান আলোচনা করে তাকেই বলা হয় অপরাধবিজ্ঞান।



অপরাধ বিজ্ঞান পাঠের উদ্দেশ্য কি?

[What is the Object of reading criminology?]


অপরাধ বিজ্ঞান পাঠের উদ্দেশ্য এই যে, এই বিজ্ঞান পাঠে অপরাধ জগৎ, অপরাধী এবং অপরাধীর মনস্তত্ব আচার-ব্যবহার কৌশল, কার্যপ্রণালী, অপরাধীর ব্যবহৃত ও পরিত্যক্ত সূত্র ও চিহ্নাদির বিশ্লেষণ, সাক্ষী ও সাক্ষ্যগ্রহণ পদ্ধতি প্রভৃতি বিষয় অবগত হওয়া যায় অপরাধের কারণ নির্ণয়, উহার সত্য উদঘাটন এবং অবশেষে অপরাধ দমন, সমাজ ও দেশকে অপরাধ মুক্ত ও কলুষমুক্ত করার পদ্ধতি জানা যায়। এই সকল পদ্ধতির সফল প্রয়োগের জন্য তদন্তকারী অফিসার ঐ অপরাধ বিজ্ঞানের মাধ্যমে তার জ্ঞান ও বুদ্ধি বৃদ্ধি করে, বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ আয়ত্ব করে, সাক্ষী, অপরাধী বা সন্দেহজনক (Suspects) ব্যক্তির মনস্তত্ত্ব আচরণ ইত্যাদিও পর্যবেক্ষণ করার দক্ষতা অর্জন করে অর্থাৎ এই বিজ্ঞান একজন পুলিস অফিসারকে সাহসী, কৌশলী ও দক্ষ করতে বিশেষভাবে সাহায্য করে। দেশের প্রচলিত আইন ভঙ্গ করলেই অপরাধ হয়। ব্যাপক অর্থে সকল অপরাধকে অন্যায় বলা হয় অর্থাৎ সমাজ যে সকল কার্যকে স্বীকৃতি দিয়েছে তা ছাড়া অন্য পথে চলা। সমাজের পরিবর্তনের সাথে সাথে প্রয়োজন অনুসারে আইনেরও পরিবর্তন ঘটে। সুতরাং সমাজের পরিবর্তন, স্থান, কাল বা মানুষের আচার-আচরণের যেমন পরিবর্তন তেমনি অপরাধেরও পরিবর্তন হয়।


প্রকৃতপক্ষে দেশের আইন-সভাই অপরাধের সংজ্ঞা নিরূপণ করেন এবং সমাজের স্বাভাবিক গতি ও করণীয় কার্য যা দ্বারা প্রতিহত হয় এমন কিছু কার্যকলাপকে অপরাধ বিজ্ঞান সুনির্দিষ্টভাবে না করার নিষেধাবলী প্রণয়ন করেন। আইনের চোখে এই মুহূর্তে যে কাজ অন্যায়, যা করলে শাস্তি হয় কালের আবর্তে সেই কাজ বা সেই লোক অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত নাও হতে পারে। আবার আমাদের দেশে যে কাজকে অপরাধ বলা হয় পাশ্চাত্যে হয়তো সেই কাজ অপরাধ বলে গণ্য নাও হতে পারে। সুতরাং আইন, অপরাধ ও শাস্তি একে অপরের সাথে যুক্ত কিন্তু কখনো স্থিতিশীল নয়। যাহোক, অপরাধ বিজ্ঞান পাঠের উদ্দেশ্য নিচে পয়েন্ট আকারে তুলে ধরা হলো—


১. অপরাধের কারণ উদঘাটন ও বিশ্লেষণ করা;


২. অপরাধ ও অপরাধীর ধরণ ও প্রকৃতি নিরীক্ষাকরণ;


৩. অপরাধী শনাক্তকরণ;


৪. ত্রুটিমুক্ত অনুসন্ধান ও তদন্ত করা;


৫. আধুনিক অপরাধ বিজ্ঞান অপরাধ ও অপরাধীর আচরণকে বিজ্ঞান সম্মত ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণকরণ;


৬. মূল উদ্দেশ্য অপরাধ ও অপরাধীকে শনাক্ত করা। আইনত শাস্তিযোগ্য তা আদালতে প্রমাণ কালে প্রামাণ্য দলিল বস্তু সাক্ষ্যসমূহ দালিলীক সাক্ষ্যসমূহকে কোর্টে গ্রহণ যোগ্যতা নিশ্চিত করা;


৭. একই অপরাধ যাতে বার বার না ঘটে তার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ কি হতে পারে তা বিশদভাবে বিশ্লেষণ করা;


৮. অপরাধ প্রবণতা হ্রাস ন্যায়-নীতি অনুসরণ কিভাবে সম্ভব তার চুলচেরা বিশ্লেষণ করা;


৯. 'পাপকে নয় পাপীকে ঘৃণা করস্ব এই মতবাদের প্রেক্ষিতে অপরাধীর দৈহিক, মানসিক ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা নির্ণয়ের জন্য তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করা;


১০. সমাজকে শান্তিতে রাখা তথা সুশীল সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলা;


১১. মক্কা-ময়াল্লেম, সান্দার, চাকমা, রাউথ, পোঁদ, ছোট ভাগিয়া ইত্যাদি প্রতারক সম্প্রদায় সম্পর্কে পূর্ব অভিজ্ঞতা অর্জন করা;


১৩. অপরাধ বিজ্ঞান পাঠে অপরাধ ও এর ঘটনার সত্যতা উন্মোচন, অবগত হওয়া;


১৪. ঘটনাস্থল থেকে বস্তু সাক্ষ্য গ্রহণ, সংরক্ষণ, প্রেরণ কিভাবে হয় অবগত হওয়া;


১৫. অপরাধ বিজ্ঞান পাঠে ভৌত বিজ্ঞান, জীব বিজ্ঞান, পদার্থ ও রসায়ন বিজ্ঞান, চিকিৎসা বিজ্ঞান, অণুবিশ্লেষণ ডি. এন. এ বিশ্লেষণে কিভাবে সহায়তা ও সাহায্য করে অপরাধী শনাক্তে তা অবগত হওয়া;


১৬. অপরাধীর অজান্তে অকুস্থলে রেখে যাওয়া হাতের আঙ্গুলের ছাপ। পায়ের ছাপ, চুল, বীর্য, রক্ত, রক্ত মাখা বস্ত্র, টুপি, রুমাল, জুতা দ্বারা কিভাবে অপরাধীকে শনাক্ত করা ও গ্রেফতার করা যায় তা অবগত হওয়া। ইত্যাদি…।।


Post a Comment

0 Comments