মেডিকেল এথিক্স: মূলনীতি ও তত্ত্ব
(Medical Ethics: Theories and Principles)
সর্বোচ্চ চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে মেডিকেল এথিক্স অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে বাংলাদেশে মেডিকেল এথিক্স তুলনামূলকভাবে একটি অনালোচিত বিষয়। এ বিষয়ে আমাদের জ্ঞান ও চিন্তার সীমাবদ্ধতা অনেক। চিকিৎসা পেশাজীবীদের অনেকের এ বিষয়ে ধারণা অপ্রতুল। ফলে বিদ্যমান চিকিৎসা ব্যবস্থা আপামর জনসাধারণের আস্থা অর্জন করতে পারছে না, ফলশ্রুতিতে দেশের মানুষ ক্রমান্বয়ে বিদেশ নির্ভর হচ্ছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে আমাদের অবশ্যই চিকিৎসা বিদ্যা অর্জন এবং চর্চার সব স্তরে নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধ নিশ্চিত করতে হবে। যাহোক,মেডিকেল এথিক্স কি কি মূলনীতি ও তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করে তা ধারাবাহিকভাবে আলোচনায় উঠে আসবে।
'মাকাসিদ আল শরিআহ' বা ইসলামি শরিআহ'র পাঁচটি মূল লক্ষ্যের আলোকে ইসলামের অত্যন্ত সুগঠিত, কঠোরভাবে সংজ্ঞায়িত নীতি বিদ্যা (Ethical Theory) রয়েছে। শরিআহ'র এ বহুল আলোচিত পাঁচটি মূল লক্ষ্য হচ্ছে যথা: দীন বা ধর্ম, জীবন (প্রাণ), বংশধর (Progeny), বুদ্ধিমত্তা/আকল (Intellect) এবং সম্পদের সংরক্ষণ। একজন চিকিৎসককে তাঁর সকল কাজ ইসলামের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য কিনা তা ওই পাঁচটি লক্ষ্য পূরণ সাপেক্ষে বিবেচনা করতে হবে।
শরিআই'র এ পাঁচটি লক্ষ্য অর্জনে চিকিৎসকের কর্মপদ্ধতি আবার পাঁচটি প্রায়োগিক পূর্বশর্ত (Qawaid Al-Shariah) পূরণ করতে হবে। এ পাঁচটি পূর্বশর্ত হচ্ছে উদ্দেশ্য (কাসদ বা Intention), সফলতা সম্পর্কে সন্দেহাতীত নিশ্চিন্ততা (ইয়াকিন বা Certainty), সম্ভাব্য ক্ষতি বিবেচনা (দারার বা Harm), অভাব বা কষ্টকর পরিস্থিতি বিবেচনা (মাশাক্কাত বা Hardship), একই কাজের পূর্ব চর্চার নজির (উরফ বা Precedence)। বস্তুত: মাকাসিদ আল শরিআহ এবং কাওয়ায়িদ আল শরিআহ'র নির্দেশনায় ইসলামের নীতিবিদ্যা বা এথিক্স ইউরোপীয় এথিক্স-এর চেয়ে আরও বিস্তৃত এবং এর ভিত্তি অনেক দৃঢ়।
মাকাসিদ আল শরিআহ (শরিআহ'র প্রধান লক্ষ্যে'র) আলোকে ইসলামি নীতিবিদ্যা
লক্ষ্য-১: দীন রক্ষা (হিফজ আল দীন/Hifz Al-Din/preserving religion)
দীন রক্ষা করার মূলনীতি মূলত: বৃহত্তর অর্থে মানুষের সকল কাজকেই ইবাদত মনে করে তাকে আল্লাহ তায়ালার নির্দেশিত লক্ষ্যে চালিত করে। এভাবে চিকিৎসা পেশাকে সরাসরি ইবাদত হিসেবে বিবেচনা করা যায়, কারণ এটি বান্দার শরীরকে রোগমুক্ত রেখে সু-স্বাস্থ্য নিশ্চিত করে তাকে আল্লাহ তায়ালার ইবাদত করবার যোগ্য ব্যক্তি হিসেবে তৈরি করে। শারীরিক ইবাদত এর ৩টি → প্রধান ধরন হচ্ছে নামায (সালাত), রোজা (সাওম) এবং হজ। একজন অসুস্থ বা দূর্বল ব্যক্তির পক্ষে এ তিনটির কোনোটিই যথাযথভাবে পালন করা সম্ভব হয় না। এছাড়াও আরো একটি স্তম্ভ ইমান (কালেমায় বিশ্বাস) দৃঢ় করবার জন্য মানসিক সুস্থতা দরকার। কারণ সঠিক আকিদা বুঝতে ও ভ্রান্ত আকিদা থেকে মুক্ত থাকতে সুস্থ মন প্রয়োজন।
লক্ষ্য-২: জীবন রক্ষা করা (হিফজ আল নাফস/Hifz al-nafs/preserving soul/life)
ইসলামি শরিআহ'র দ্বিতীয় প্রধান লক্ষ্য 'হিদ আল নাক্স' বা জীবন রক্ষা করাটা হচ্ছে চিকিৎসাবিদ্যার প্রাথমিক এবং মৌলিক উদ্দেশ্য। যদিও মনে রাখতে হবে যে, চিকিৎসা ব্যবস্থা মানুষের মৃত্যুকে রুখতে বা স্থগিত রাখতে পারে না কারণ মৃত্যুর মালিক তো একমাত্র আল্লাহ তায়ালা। চিকিৎসা যা করতে পারে তা হচ্ছে আল্লাহ তায়ালা নির্ধারিত মৃত্যুর সময় আসা পর্যন্ত মানুষের জীবনকে আরামদায়ক, ব্যথামুক্ত ও সচল রাখতে সাহায্য করা। চিকিৎসা জীবনকে অব্যহত রাখতে এবং শংকামুক্ত রাখতে জীবনহানিকর যেকোনো হুমকি (জীবানু বা রোগ) অপসারণ করে এবং শরীরের সকল অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে যথাযথভাবে সক্রিয় রাখে। যেসব রোগ মানুষের স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে চিকিৎসা জ্ঞান সেসব রোগের উপশম ও প্রতিরোধের উপায় বাতলে দেয়। এভাবে রোগের চিকিৎসা এবং পুনর্বাসনের মাধ্যমে ওষুধ মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত করে। কাজেই শরিআহ'র দ্বিতীয় প্রধান লক্ষ্যের সাথে ওষুধের ওতপ্রোত সম্পর্ক রয়েছে।
লক্ষ্য-৩: বংশধারা রক্ষা করা (হিফজ আল নাসল/Hifz An-Nasl/preserving offspring or human progeny)
মানুষের ভবিষ্যত প্রজন্মকে রক্ষা করা সংক্রান্ত শরিআহ'র এ তৃতীয় লক্ষ্য অর্জনে ওষুধ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। চিকিৎসাশাস্ত্র এটি নিশ্চিত করে যে, আজকের শিশু সুস্থভাবে বড় হয়ে আগামী দিনের সফল ও সক্ষম নাগরিক হবে। এ লক্ষ্যে শিশুর যত্নের বিধিবিধান চিকিৎসাশাস্ত্র দিয়ে থাকে। মানুষের সন্তান জন্মদানে অক্ষমতার চিকিৎসাও শরিআহ'র এ লক্ষ্যেই চালিত। একইভাবে গর্ভবতী মায়ের যত্ন, শিশুর জন্মের পূর্বে এবং জন্মের পর চিকিৎসা, শৈশব, বয়ঃসন্ধিকাল এবং কৈশোরের চিকিৎসাও মানুষের বংশধারা রক্ষার শরিআই'র লক্ষ্যকে বাস্তবায়িত করে। আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্রে জন্মের পূর্ব থেকেই শিশুর যত্ন বা গর্ভবতী হবার পরিকল্পনা গ্রহণের দিন থেকেই অনাগত শিশুর যত্ন নিশ্চিত করা হয়। এ কাজ শরিআহ'র লক্ষ্যের সাথে সংগতিপূর্ণ।
লক্ষ্য-৪: বুদ্ধিমত্তা ও মননের সংরক্ষণ (হিফজ আল আকল/Protection of mind (Hifz al-Aql/preserving intellect)
চিকিৎসাশাস্ত্র মানুষের সুস্থদেহে সুন্দরমন নিশ্চিত করে শরিআহ'র এ চতুর্থ লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করে। শারীরিক পীড়ার অবসান মানুষের মনকেও পীড়া এবং অবসাদমুক্ত করে। বিশেষ ধরনের মানসিক রোগ নিউরোসিস এবং সাইকোসিস এর চিকিৎসা মানুষের মননকে পুনরুদ্ধার করে তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক এবং আবেগ প্রবণ কর্মকাণ্ডকে পুনর্জীবিত করে। মাদকাসক্তি এবং ওষুধের নেশা প্রতিরোধে চিকিৎসা প্রকারান্তরে মানুষের বোধ ও মননকে ধ্বংসের পথ থেকে রক্ষা করে।
লক্ষ্য-৫: মানুষের সম্পদের সংরক্ষণ (হিফজ আল মাল/hifz al-mal/preserving property)
যেকোনো সমাজের সম্পদ অর্জন ও ধারণ ক্ষমতা নির্ভর করে ওই সমাজের স্বাস্থ্যবান জনগণের কর্মতৎপরতার ওপর। কাজেই শরিআহ'র পঞ্চম প্রধান লক্ষ্য 'হিদ আল মাল' অর্জনে ওষুধ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সমাজের মানুষের রোগ প্রতিরোধ করে স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন করে, রোগের চিকিৎসা ও পুনর্বাসন করে ওষুধ মানুষের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করে। দূর্বল স্বাস্থ্যসম্পন্ন সমাজ বা জাতির চেয়ে চাইতে সুস্বাস্থ্যসম্পন্ন জাতি অনেক গতিশীল হয়। এখানে চরম অসুস্থ (Terminally III) ব্যক্তির চিকিৎসার বিষয়ে শরিআহ'র দু'টো লক্ষ্য যথা: জীবন রক্ষা ও সম্পদের সংরক্ষণ অনেক সময় সাংঘর্ষিক হতে পারে। যেমন অনেক সময় জীবনের আশাহীন চরম অসুস্থ ব্যক্তির চিকিৎসায় এত বেশি ব্যয় হচ্ছে যা দিয়ে সম্ভাবনাময় অনেক জীবন রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা যাবে- এসব ক্ষেত্রে কি করণীয় হতে পারে? অনেক সময় জীবন রক্ষার উদ্যোগ আদৌ ব্যয়সাশ্রয়ী কিনা সে প্রশ্ন উঠে। এ বিষয়ে যেসব দেশে রাষ্ট্র চিকিৎসার ব্যয় বহন করে সেখানে সীমিত বাজেট যোগ্যতর হকদারদের মাঝে যথাযথভাবে ব্যয় হচ্ছে কিনা সেই প্রশ্নও এসে যায়। এসব বিষয়ে শরিআহভিত্তিক সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে চিকিৎসকরা আলেম, আইনপ্রণেতা ও রাষ্ট্রনায়কদের সাহায্য করতে পারেন।
'ক্বাওয়ায়িদ আল ফিকাহ' বা ফিকাহর পদ্ধতির আলোকে ইসলামি নীতিবিদ্যার কর্মকৌশল (মূলনীতি)
মূলনীতি-১: কাজের উদ্দেশ্য (The Principle of Intention 'ক্বায়িদাত আল ক্বাসদ')
এ মূলনীতিটি কয়েকটি উপশাখা নিয়ে গঠিত। এর একটি হচ্ছে, মানুষের প্রতিটি কর্মের ফল তাঁর উদ্দেশ্য (নিয়ত)-এর ওপর নির্ভরশীল। এ মূলনীতি চিকিৎসকদের সর্বদা এ কথা স্মরণ করিয়ে দেয় যে তিনি যে কাজ করতে যাচ্ছেন তার পেছনে রোগীর জন্য নিখাদ কল্যাণের চিন্তাই নিহিত আছে কি না?
এ মূলনীতির আর একটি উপশাখা হচ্ছে 'নিয়ম বা আইনে কি আছে তা নয় ব্যক্তির নিয়তই প্রধান বিবেচ্য'। এর প্রয়োগ আমরা এভাবে করতে পারি যে কোনো ভ্রান্ত বা অনৈতিক কাজকে যৌক্তিক প্রমাণিত করতে আমাদের প্রাপ্ত তথ্য ও উপাত্ত ব্যবহার করা যাবে না। নিয়তের আরো একটি উপশাখা হচ্ছে 'কাজের বিচার নিয়তের ভিত্তিতেই হবে'-এর বাস্তব প্রয়োগ হচ্ছে যেকোনো প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পদ্ধতিও অনৈতিকভাবে প্রয়োগ করা যাবে না।
মূলনীতি-২: কাজের সাফল্যের বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া(The Principle of Certainty 'ক্বায়িদাত আল ইয়াকীন')
অধিকাংশ চিকিৎসা রোগনির্ণয় (Medical diagnoses) 'ইয়াকীন' বা পরিপূর্ণ নিশ্চয়তার সাথে করা যায় না। এ ক্ষেত্রে চিকিৎসককে চিকিৎসার সিদ্ধান্ত নিতে হয় কয়েকটি সম্ভাব্য পার্থক্যমুলক রোগনির্ণয় থেকে যেটি সবচেয়ে সম্ভাব্য তা অনুমান করে। নতুন নতুন তথ্য পাওয়ার ভিত্তিতে এবং প্রযুক্তির সংযোজনে এ রোগ নির্ণয় পরিবর্তিত বা আরো পরিশীলিত হতে পারে। এ প্রাথমিক পার্থক্যমুলক রোগনির্ণয় এবং তৎপরবর্তী সাময়িক রোগনির্নয়পত্র পুরো চিকিৎসাকেই প্রভাবিত করে। কাজেই এ পর্যায়ে চিকিৎসককে সিদ্ধান্ত নিতে হয় অত্যন্ত সুগঠিত, শান্তভাবে, অনুরাগ-বিরাগ এর ঊর্ধ্বে উঠে। এখানে কিছু রোগনির্ণয়ে উপনীত হবার কিছু চালু শিষ্টাচারবিধি আছে। নতুন কিছু আবিষ্কৃত না হলে সেই চালু শিষ্টাচারবিধিতে অটল থাকাই পেশার দাবি। একই রোগের চিকিৎসায় বিভিন্ন ওষুধের মাঝে ওই জনগোষ্ঠীতে সর্বোচ্চ ফল পাওয়া ওষুধের কিছু দৃষ্টান্ত থাকে। এ ধরনের যেকোনো পূর্বনীতি যদি ভুল বা বর্তমানে অকার্যকর প্রমাণিত না হয় তবে তা বাদ দেয়া সমীচিন হবে না। মানব স্বাস্থ্যের কল্যাণে চিকিৎসার সব পদ্ধতিই অনুমোদিত যদি না তার নিষিদ্ধ হবার পক্ষে কোনো শরয়ি দলিল থাকে। সার্বিকভাবে স্বাস্থ্য সেবার অনুমোদনের এ উদারনীতি আবার 'পুনরুৎপাদনশীল' প্রযুক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। সেই বিষয়ে পৃথকভাবে গবেষণা করে সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হবে।
মূলনীতি-৩: কাজের ফলে সৃষ্ট ক্ষতি প্রসঙ্গে (The Principle of Injury 'ক্বায়িদাত আল জারাহ')
যেকোনো 'চিকিৎসা হস্তক্ষেপ' ততক্ষণ গ্রহণযোগ্য এবং যৌক্তিক, যতক্ষণ তা যেকোনো ক্ষত/রোগের উপশম ঘটাবে। কখনই এক রোগের উপশম ঘটাতে গিয়ে আরেক রোগের উদ্ভব ঘটানো চলবে না। যখন সম্ভাব্য চিকিৎসার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অনিবার্য তখন আমরা মূল রোগ এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার মাঝে কোনটি রোগীর জন্য বেশি কষ্টদায়ক তা দেখে কর্মপন্থা নির্ধারণ করি। যদি চিকিৎসার সুফল প্রতিক্রিয়ার চেয়ে অনেক বেশি হয় তবেই আমরা রোগীকে চিকিৎসা দেই। যদি চিকিৎসার সুফলের চেয়ে প্রতিক্রিয়া বেশি বা একই রকম হয় তবে আমরা বিষয়টি রোগীকে ব্যাখ্যা করে বলি। চিকিৎসক প্রায়ই এমন উভয় সংকটে পড়েন যে, সম্ভাব্য চিকিৎসা দেবার পক্ষে-বিপক্ষে সমান যুক্তি আছে। এক্ষেত্রে ইসলামি আইনের বিধান হল যদি চিকিৎসার সুফল এবং কুফল সমান হয় তবে চিকিৎসায় না যাওয়াই উত্তম। একই ধরনের উভয় সংকট কোনো চিকিৎসার দুটো পদ্ধতির ক্ষেত্রে কোনটি নেয়া হবে সেই প্রশ্নে উঠতে পারে। এক্ষেত্রে দুই পদ্ধতির যেটা কম খরচ, কম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, এবং সহজে গ্রহণযোগ্য তাই উত্তম। দুটো অনিবার্য ক্ষতির একটি নিতে হলেও (যেমন: যখন গর্ভস্থ শিশুকে বাঁচাতে গেলে মায়ের জীবন ঝুঁকিপূর্ণ সেক্ষেত্রে মায়ের জীবনের অধিকারই অগ্রগণ্য) একই পন্থায় অগ্রসর হতে হবে।
সকল চিকিৎসার (বিশেষত অপারেশন) ক্ষেত্রে এটি মনে রাখতে হবে যে আমরা একটি বড় ক্ষতি অপসারণে একটি ছোট ক্ষতি করছি। জনস্বাস্থ্য নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে কম্যুনিটি বা সমাজের স্বার্থকে ব্যক্তি স্বার্থের ওপরে স্থান দিতে হবে। এক্ষেত্রে চিকিৎসকগণ অনেক সময় ব্যক্তিকে বুঝাতে সক্ষম হবেন যে জাতি বা সমাজের স্বার্থে তাকে (রোগীকে) কিছু সুবিধা ত্যাগ করতে হবে। একইভাবে মারাত্মক সংক্রামক কোনো রোগ প্রতিরোধে চিকিৎসক রাষ্ট্রকে জাতির স্বার্থ রক্ষায় ব্যক্তির স্বাধীনতা সীমিত করার মতো পরামর্শও দিতে পারেন। চিকিৎসকের জীবনে এমন অনেক সময় আসে যখন (চিকিৎসায় হস্তক্ষেপ করা বা না করার সিদ্ধান্ত নিতে চিকিৎসকদেরকে রীতিমত 'ইস্তিখারা নামায' পড়তে হয়।
মূলনীতি-৪: জরুরি বা দুর্যোগ পরিস্থিতি মোকাবেলার বিধান ('ক্বায়িদাত আল মাশাক্কাত' The Principle of Hardship)
জরুরি জীবন রক্ষাকারী পরিস্থিতিতে অন্য সময়ে নিষিদ্ধ কোনো পন্থাও জীবন বাঁচাতে প্রয়োগের অনুমোদন ইসলাম দেয়। এ নীতিকেই ইসলামের পরিভাষায় বলা হয় 'ক্বায়িদাত আল মাশাক্কাত'। জরুরি প্রয়োজন নিষেধাজ্ঞাকে সাময়িক রদ করে। মেডিকেল পরিভাষায় মাশাক্কাত (Hardship) হচ্ছে এমন অবস্থা। যখন হাতের কাছে মজুদ জ্ঞান ও প্রযুক্তি দিয়ে রোগীকে তাৎক্ষণিকভাবে চিকিৎসা না দিলে তা তাঁর মৃত্যু/অঙ্গহানি বা অন্য কোনো মারাত্মক শারীরিক/ মানসিক বৈকল্য ঘটাবে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে শরিআহ যথাসম্ভব উদার এবং নমনীয়।। তবে কঠোর খেয়াল রাখতে হবে যেন এসব ক্ষেত্রে শরিআহ'র মূল লক্ষ্যের বিচ্যুতি না ঘটে। আরও মনে রাখতে হবে যে, আইনের এ ব্যতিক্রম বা নমনীয়তা চিরস্থায়ী নয়, জরুরি সংকটময় অবস্থা কেটে গেলে আবারো আগের মত নিষেধাজ্ঞা চলে আসবে। এ ধরনের সাময়িক অনুমোদিত (অথচ চূড়ান্তভাবে নিষিদ্ধ) কাজ করার জন্য অন্য কাউকে দায়িত্ব দেয়া ঠিক নয়। স্বাভাবিক জনশক্তি দিয়েই এ কাজ করতে হবে। তা না হলে কারো মনে হবে যে তাকে দিয়ে শুধু নিষিদ্ধ কাজই করানো হয় (যেমন কোনো নিদিষ্ট নার্স বা ধাত্রীবিদকে দিয়েই যদি সব সময় অনুমোদিত গর্ভপাত করানো হয়)।
মূলনীতি-৫: একই ধরনের কাজের পূর্ব দৃষ্টান্ত বা প্রথা থাকা ('ক্বায়িদাত আল উরফ' The Principle of Custom or Precedent)
ইসলামের এ মূলনীতির ভিত্তি হচ্ছে এ যে, একই কাজের পূর্ব দৃষ্টান্ত বা প্রথা থাকা উক্ত কাজকে বৈধতা দেবার ভিতকে মজবুত করে। এক্ষেত্রে 'নজির' বা প্রথা বলতে এমন কাজ বা পন্থাকেই বুঝাবে যার চর্চা ব্যাপক, সর্বত্র একই রকম এবং যার চর্চা সম্পর্কে কারো কোনো সন্দেহ, সংশয় নেই। নব আবিস্কৃত পদ্ধতি সফলভাবে চর্চা হয়ে গেলে ভবিষৎ প্রজন্মের জন্য তা রীতি হয়ে যায়। কাজেই চিকিৎসকগণ একদিকে প্রচলিত রীতির অনুসারী আবার অপরদিকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য রীতির প্রবর্তক। বর্তমান স্বাস্থ্য সেবার মানকে পূর্বের মানদন্ডের সাপেক্ষেই যাচাই করা হয়।
………..
source:১. মেডিকেল এথিক্স—প্রফেসর ড. ওমর হাসান কাসুলী[বই কেনার লিংক]
ড. শারমিন ইসলাম মাহমুদ (অনুবাদক)
ড. আবু খলদুন আল মাহমুদ (অনুবাদক)
[মূল বই: Medical Ethics : Occasional Paper Series / Omar Hasan Kasule]
0 Comments