আইনে ব্রেইন ড্রেথ (Brain Death in Law)
সাধারণত “ব্রেইন ডেথ” এমন এক বিচিত্র মৃত্যু, যেখানে মানুষের আত্মা মরে গেলেও শরীরকে ঠিক মৃত বলা যায় না। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় স্ট্রোক, মস্তিষ্কে আঘাত, মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচার বা অন্য কোন কারণে যদি কোন ব্যক্তির ব্রেইন স্টেমের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়, তখন তাকে ‘ব্রে ইন ডেথ’ বলা হয় । আইনগতভাবে বললে বলা যায় যে মৃত্যুর একটি আইনি সংজ্ঞা হলো“ব্রেইন ডেথ”।
ব্রেইনস্টেম (brainstem) হলো মানুষের বেঁচে থাকার জন্য মস্তিষ্কের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ যা মানবদেহের হৃদ্যন্ত্র, ফুসফুসসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে। এই ব্রেইনস্টেম অকার্যকর হয়ে সাধারণত রোগী আর বাঁচে না। তখন আইনের শর্তাবলী ও অন্যান্য বিধান প্রতিপালন সাপেক্ষে রোগীর ‘ব্রেইন ডেথ’ ঘোষণা করা হয়। চিকিৎসাবিজ্ঞানে এরূপ মৃত্যুকে ব্রেন স্টেম ডেথ(Brain stem death) বা হোল ব্রেন ডেথও(whole-brain death) বলা হয়। ১৯৮১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে আইনের মাধ্যমে সারকুলেটরি ডেথ (হৃদ্যন্ত্রের ক্রিয়াবন্ধজনিত মৃত্য) এবং হোল ব্রেন ডেথ (মস্তিষ্কের পুরো কর্মকাণ্ড বন্ধ কিন্তু হৃদ্যন্ত্র সচল থাকে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত) এই দুই ধরনের মৃত্যুকে সংজ্ঞায়িত করা হয়।
বাংলাদেশের আইনে ব্রেইন ড্রেথ (Brain Death)
মানবদেহে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইন, ১৯৯৯(সংশোধন-২০১৮ ) এর ধারা-৫তে নিন্মোক্তভাবে ব্রেইন ডেথ ঘোষণা নিয়ে বিধান বর্ণিত রয়েছে—
৫(১) ধারার অন্যান্য বিধান সাপেক্ষে, মেডিসিন অথবা ক্রিটিক্যাল কেয়ার মেডিসিন, নিউরোলজি এবং এ্যানেসথেসিওলজি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক অথবা সহযোগী অধ্যাপক পদমর্যাদার অন্যূন ৩(তিন) জন চিকিৎসক সমন্বয়ে গঠিত কমিটি কোন ব্যক্তির ব্রেইন ডেথ ঘোষণা করতে পারবে:
তবে শর্ত থাকে যে, ব্রেইন ডেথ ঘোষণাকারী কমিটির কোন চিকিৎসক বা তাহার কোন নিকট আত্মীয় এইরূপ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপন বা সংযোজন প্রক্রিয়ার সাথে কোনভাবে জড়িত থাকতে পারবেন না।
(২) কোন ব্যক্তির ব্রেইন ডেথ ঘোষণা করা যাবে না, যদি না নিম্নবর্ণিত শর্তসমূহ পূরণ হয়, যথা–
(ক) অন্যূন ১২ (বারো) ঘন্টা সুস্পষ্ট কারণে অবিরাম কোমা (Coma) অবস্থায় থাকলে:
তবে শর্ত থাকে যে, এই দফার উদ্দেশ্য পূরণকল্পে, নিম্নবর্ণিত কোন কারণে কোমা অবস্থার সৃষ্টি হলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না, যথা:-
(অ) কার্ডিওজেনিক শক(Cardiogenic shock) হতে রিভাইভকৃত ব্যক্তির কোমা অবস্থা ৩৬ (ছত্রিশ) ঘন্টা অতিবাহিত না হলে;
(আ) কোমার অব্যবহিত পূর্বে শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রা ৩৫° সেলসিয়াসের নীচে হলে; এবং
(ই) কোন ঔষধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ায় কোমা অবস্থার সৃষ্টি হলে;
(খ) কোমার পূর্বে কোন মেটাবোলিক বা এন্ডোক্রাইন ডিসঅর্ডার নিরসন না হলে;
(গ) স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাস প্রক্রিয়া অকার্যকর হওয়ার পর ভেন্টিলেটরের মাধ্যমে শ্বাস-প্রশ্বাস সঞ্চালন করা হলে; এবং
(ঘ) নিম্নবর্ণিত অবস্থায় ব্রেইন স্টেম রিফ্লেক্স সম্পূর্ণভাবে অনুপস্থিত থাকলে, যথা—
(অ) দুই চোখের মণি প্রসারিত ও স্থির (ডাইলেটেড এবং ফিক্সড) থাকলে;
(আ) দুই চোখের কর্ণিয়ায় রিফ্লেক্স এর অনুপস্থিতি;
(ই) যে কোন ধরনের পেইন সেনসেশন (Pain Sensation) রিফ্লেক্স এর অনুপস্থিতি;
(ঈ) অকুলো কেফালিক( Oculocephalic)বা ডলস রিফ্লেক্স এর অনুপস্থিতি; এবং
(উ) ভেসটিবিউলো অকুলার রিফ্লেক্স(Vestibulo-ocular Reflex) এর অনুপস্থিতি।
(৩) উপ-ধারা (২) এ বর্ণিত অবস্থার অনুপস্থিতিতে নিম্নবর্ণিত পরীক্ষা দ্বারা ব্রেইন ডেথ ঘোষণা করা যাবে, যথা―
(ক) ন্যূনতম ৩০(ত্রিশ) মিনিটব্যাপি মস্তিষ্কের ইলেক্ট্রোএনসেফালোগ্রাম/ electroencephalogram (ইইজি/ EEG) পরীক্ষা অথবা মস্তিষ্কের এনজিওগ্রাম (angiogram);
(খ) এপনিয়া টেস্ট(apnea test): ব্যাখ্যা: এ ধরণের পরীক্ষায় রক্তের মধ্যে অক্সিজেনের মাত্রা, মস্তিষ্কের তরঙ্গ, শ্বাস-প্রশ্বাস, পায়ের নড়াচড়া এবং হৃদস্পন্দন রেকর্ড পরীক্ষা করা হয়।
(৪) ২ (দুই) বৎসর হইতে ১৩ (তেরো) বৎসর বয়স্ক কোন শিশুর ব্রেইন ডেথ ঘোষণা করতে হলে সংশ্লিষ্ট শিশুটিকে ইলেক্ট্রোএনসেফালোগ্রাম (ইইজি) পরীক্ষা দ্বারা অন্যূন ১২ (বারো) ঘন্টা পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
ব্রেইন ডেথ ঘোষণার মাধ্যমে যদি কোন রোগী ক্যানসার, হেপাটাইটিস, এইচআইভি ইত্যাদি রোগে আক্রান্ত না হয়, ক্যাডাভেরিক(cadaveric) (যাদের মস্তিষ্ক অচল এবং বাঁচার কোনো সম্ভাবনা থাকে না) হিসেবে তারা কিডনি, হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস, যকৃৎ বা লিভার, অগ্ন্যাশয় (প্যানক্রিয়াস) ও খাদ্যনালির মতো অঙ্গগুলো দান করলে অন্য ব্যক্তির দেহে প্রতিস্থাপন করা যায়।
মানবদেহে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংযোজন আইন, ১৯৯৯ এর মাধ্যমে বাংলাদেশে চিকিৎসকেরা ব্রেইন ডেথ ঘোষণা করার সুযোগ পান। ২০২৩ সালে বাংলাদেশের ইতিহাসে সারাহ ইসলামই প্রথম ব্যক্তি, যিনি ব্রেইন ডেথ থেকে মৃত্যুর আগে নিজের অঙ্গ দান করেছেন।
0 Comments