আঘাত ও গুরুতর আঘাত (Hurt and grievous hurt) কাকে বলে? গুরুতর আঘাতের শাস্তি আলোচনা করুন। আঘাত ও গুরুতর আঘাতের পার্থক্য আলোচনা করুন।

 

প্রশ্ন: আঘাত ও গুরুতর আঘাত (Hurt and grievous hurt) কাকে বলে? গুরুতর আঘাতের শাস্তি আলোচনা করুন। আঘাত ও গুরুতর আঘাতের পার্থক্য আলোচনা করুন।

আঘাত (Hurt)

দন্ডবিধির ৩১৯ ধারায় বলা হয়েছে, কেউ যদি অন্য কোন ব্যক্তির দৈহিক যন্ত্রণা, রোগ বা অপারগতা ঘটায় তবে সে আঘাত (Hurt) করেছে বলা হবে (Whoever causes bodily pain, disease, or infirmity to any person is said to cause hurt)।

দন্ডবিধি দন্ডবিধি ১৮৬০ এর ৩১৯ হইতে ৩৩৮ ধারা পর্যন্ত বিভিন্ন রকমের আঘাতের কথা বলা হয়েছে। দন্ডবিধি ১৮৬০ এর ৩৫১ ধারায় আক্রমনের ফলে সৃষ্ট শারীরিক ব্যথা, ব্যধি ও অক্ষমতার কথা বলা হয়েছে। স্বামী যদি তাঁর স্ত্রীকে লাঠি দ্বারা প্রহার করে তবে দন্ডবিধি ১৮৬০ এর ৩১৯ ধারানুযায়ী তা আঘাত বলে গণ্য হবে।

আঘাত প্রত্যক্ষ/পরোক্ষভাবে হতে পারে। আবার কোন কাজের মাধ্যমে দূরবর্তী/সুদুরপ্রসারী ফল হিসেবে প্রকাশ পেতে পারে। দৈনিক যন্ত্রণা বলতে দেহ বা শরীরে প্রভাব সৃষ্টিকারী কার্যকে বুঝায়। বেদনা/যন্ত্রণা অনুভব করলেই যে আঘাত হবে এমন কোন কথা নাই। যন্ত্রণা ছাড়াও যদি কোন রোগজীবানু অন্যের শরীরে প্রবেশ করে দেওয়া হয়, তবে তা অপরাধ বলে গণ্য হবে। যেমন- এইডস রোগাক্রান্ত ব্যক্তি কোন নারীর সাথে যৌন সংগম করায় এইডস জীবানু সেই নারীর দেহে প্রবেশ করলে এই ধারানুযায়ী ঐ ব্যক্তি আঘাত দিয়েছে বলে গণ্য হবে।

স্নায়ুবিক দুর্বলতায় ভুগছে এমন কোন শিশুর সামনে অন্ধকার রাত্রে কিম্ভূতকিমাকার পোশাকে ভুতের ভয় দেখালে তাকে দৈনিক যন্ত্রণা বলে গণ্য করা হয়।

গুরুতর আঘাত (Grievous hurt)

দণ্ডবিধি আইনের ৩২০ ধারা অনুযায়ী নিম্নোক্ত শ্রেণিসমূহে আঘাত কে গুরুতর আঘাত বা মারাত্মক জখম(Grievous hurt) বলে বিবেচনা করা হবে—

১. পুরুষত্বহীনকরণ(Emasculation): . পুরুষত্বহীনকরণ নানাভাবে হতে পারে। পুরুষের যৌনাঙ্গে আক্রান্ত করে তাকে স্থায়ীভাবে পুরুষত্বহীন করা যায়। এই স্থানে আঘাতের ফলে ব্যক্তির অস্থায়ী পুরুষত্বহীন ঘটাতে পারে।

২. স্থায়ীভাবে দুই চোখের যে কোনটির দৃষ্টিশক্তি রহিতকরণ(Permanent privation of the sight of either eye): বিভিন্ন ভাবে এই ধরনের আঘাত হানা যায়। লাঠি দিয়া চক্ষু গালিয়া দেওয়া যায়/আগুন/চাকু দ্বারা চক্ষু তুলে নেওয়া যায়। আহত ব্যক্তি শুধু তার দৃষ্টিশক্তি হারান না, চক্ষু নাশের মাধ্যমে তিনি তার অংগ হারিয়ে ফেলেন।

৩. স্থায়ীভাবে দুই কানের যে কোনটির শ্রবণশক্তি রহিতকরণ(Permanent privation of the hearing of either ear): মাথার/কানে ঘুষি দিয়া বা কানের মধ্যে লাঠি ঢুকাইয়া বা কানের মধ্যে কিছু চালাইয়া মানুষকে বধির করা যায়।

৪. যে কোন অঙ্গ বা গ্রন্থির অনিষ্ট সাধন(Privation of any member or joint): স্কন্ধের(কাঁধ) কোন গুরুত্বপূর্ন অংশে বড় রাম দা / তলোয়ার দিয়া আঘাত করে কেটে ফেলাকে অংগের অনিষ্ট সাধন বলা যায়।

৫. যে কোন অঙ্গ বা গ্রন্থির কর্মশক্তি সমূহের বিনাশ বা স্থায়ী ক্ষতিসাধন(Destruction or permanent impairing of the powers of any member or joint): দেহের অংগ ও গ্রন্থি দেহকে সবল রাখে। কোন অংগের বা গ্রন্থির অনিষ্ট সাধন করিলে মানুষ পঙ্গু হইয়া যায়।

৬. মস্তক বা মুখমণ্ডলের স্থায়ী বিকৃতিকরণ(Permanent disfiguration of the head or face): কান কেটে নিয়ে, কপালে দাগ দিয়া, গাল পোড়িয়ে বা এই প্রকারের কোন কাজ করে বিকৃতি ঘটানো যায়। নাসিকার সেতুর উপর আঘাত করলে বিকৃতি(disfiguration) ঘটে।

৭. হাড়, দাঁতভাঙ্গা বা গ্রন্থিচ্যুতকরণ(Fracture or dislocation of a bone or tooth): হাড়ের উপর দাগ পড়লে তাকে ভাঙ্গা বলে না। ভাঙ্গা বলতে এক অংশ হতে অন্য অংশ বিচ্যুতকে বুঝায়। স্থানচ্যুত বলতে যে স্থানে সে অংগের থাকার কথা সে স্থানে হতে তা অন্য স্থানে সরে যাওয়াকে বুঝায়।

৮. যে আঘাত জীবন বিপন্ন করে বা আঘাতপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে বিশ দিন মেয়াদের জন্য তীব্র দৈহিক যন্ত্রনা দান করে বা তাকে তার সাধারণ পেশা অনুসরণ করতে অসামর্থ করে তাই গুরুতর আঘাত বলে বিবেচিত হবে(Any hurt which endangers life or which causes the sufferer to be during the space of twenty days in severe bodily pain, or unable to follow his ordinary pursuits): যে আঘাতের বেদনা ২০ দিনের অধিক স্থায়ী থাকে, সেই আঘাত গুরুতর আঘাত বলে গণ্য হবে। যে আঘাতের ফলে আহত ব্যক্তি তার নিজের কাজ করতে অক্ষম হয়ে পড়ে সেই আঘাতও গুরুতর আঘাত বলে গণ্য।[State of Gujarat v. Samaj, MANU/GJ/0064/1969 : AIR 1969 Guj 337]

আঘাত ও গুরুতর আঘাতের পার্থক্য

(Difference between hurt and grievous hurt):

আঘাত	গুরুতর আঘাত
১। দণ্ডবিধি আইনের ৩১৯ ধারায় ধারায় আঘাত এর সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে।	১। আইনের ৩২০ ধারায় দণ্ডবিধি আইনের ৩২০ ধারায় গুরুতর আঘাত এর সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে।
২। আঘাতের প্রকৃতি সাধারণ হয়।	২। গুরুতর আঘাতের প্রকৃতি গুরুতর হয়ে থাকে ।
৩। আঘাতের ক্ষেত্রে আদালত অনেকটা নমনীয় মনোভাব পোষণ করে।	৩। গুরুতর আঘাতের ক্ষেত্রে আদালত কঠোর মনোভাব পোষণ করে থাকে।
৪। স্বেচ্ছাকৃত আঘাতের শাস্তি ১ বছর পর্যন্ত সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ড বা ১ হাজার টাকা পর্যন্ত যে কোন অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডেদণ্ডিত হবে।	৪। স্বেচ্ছাকৃত গুরুতর আঘাতের শাস্তি ৭ বছর পর্যন্ত সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ড।
৫। এটি অধর্তব্য অপরাধ বলে বিবেচিত হয়।	৫। এটি ধর্তব্য অপরাধ বলে বিবেচিত।
৬। আঘাত এটি একটি নন-কগনিজেবল এবং জামিনযোগ্য অপরাধ।	৬। গুরুতর আঘাত : এটি একটি আমলযোগ্য এবং জামিনযোগ্য অপরাধ।
৭। Mens Rea বিবেচনায় নিয়ে বলা যায় যে আঘাত ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত হতে পারে।	.৭। অন্যদিকে গুরুতর আঘাত করার জন্য অবশ্যই ইচ্ছাকৃত হয়ে থাকে।
৮। আঘাতের ফলে শারীরিক ব্যথা, অসুস্থতা বা infirmity দেখা যায়।	৮। কিন্তু গুরুতর আঘাতের ফলে  শরীরের প্রয়োজনীয় অঙ্গ(চোখ, কান, জয়েন্ট) ইত্যাদির স্থায়ী বা দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি হতে পারে ।

আঘাত ও গুরুতর আঘাতের শাস্তিসমূহ

(Punishment for hurt and grievous hurt)

অপরাধসমূহ	দণ্ডবিধি আইন অনুসারে আঘাত ও গুরুতর আঘাতের শাস্তিসমূহ
ইচ্ছাকৃতভাবে আঘাত করা(ধারা-৩২৩)	১ বৎসর সশ্রম/বিনাশ্রম কারাদন্ড বা ১,০০০ টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ড
মারাত্মক অস্ত্র দ্বারা বা মারাত্মক উপায়ে ইচ্ছাকৃতভাবে আঘাত করা(ধারা-৩২৪)	৩ বৎসর সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদন্ড বা জরিমানা বা উভয়দন্ড
ইচ্ছাকৃতভাবে গুরুতর আঘাত করা(ধারা-৩২৫)	৭ বৎসর সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদন্ড বা জরিমানা
মারাত্মক অস্ত্র দ্বারা বা মারাত্মক উপায়ে ইচ্ছাকৃতভাবে গুরুতর আঘাত করা(ধারা-৩২৬)	যাবজ্জীবন কারাদন্ড বা ১০ বৎসর সশ্রম/বিনাশ্রম কারাদন্ড ও অর্থদন্ড
ক্ষয়কারক দ্রব্য দ্বারা দুই চোখ, মাথা এবং মুখমন্ডলে মারাত্মক আঘাত(ধারা-৩২৬ক)	মৃত্যুদন্ড বা যাবজ্জীবন কারাদন্ড এবং জরিমানা
সরকারী কর্মচারীকে তার কর্তব্যে বাঁধা দানের জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে আঘাত করা(ধারা-৩৩২)	৩ বৎসর সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদন্ড বা জরিমানা বা উভয়দন্ড
সরকারী কর্মচারীকে তার কর্তব্যে বাঁধা দানের জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে গুরুতর আঘাত করা(ধারা-৩৩৩)	১০ বছর সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদন্ড এবং অর্থদন্ড
যে ব্যক্তি উস্কানি দিয়েছে সেই ব্যক্তি ব্যতীত অন্য কাউকে আঘাতের সংকল্প না করে মারাত্মক ও আকস্মিক উস্কানিবশত ইচ্ছাকৃতভাবে আঘাত করা।(ধারা-৩৩৪)	১ মাস সশ্রম/বিনাশ্রম কারাদন্ড বা ৫০০ টাকা জরিমানা বা উভয়দণ্ড
যে ব্যক্তি উস্কানি দিয়েছে সেই ব্যক্তি ব্যতীত অন্য কাউকে আঘাতের সংকল্প না করে মারাত্মক ও আকস্মিক উস্কানিবশত গুরুতর আঘাত করা(ধারা-৩৩৫)	৪ বছর সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদন্ড বা ২,০০০ টাকা জরিমানা বা উভয় প্রকার শাস্তি