ভরণ-পোষণ/খোরপোষ
[What is Maintenance]
ভরণ-পোষণকে(Maintenance) আরবীতে বলা হয় নাফাকাহ বা নাফাকা Nafaqah (نَفَقَة) or nafka(finance support)। ভরণ-পোষণের আওতায় খাদ্য, বস্ত্র,বাসস্থান, শিক্ষার ব্যয় এবং শারীরিক ও মানসিক পুষ্টির জন্য অন্যান্য প্রয়োজনীয় বিষয় অর্থাৎ মানুষের মূল চাহিদা অন্তর্ভূক্ত রয়েছে। ভরণ-পোষণের আরেক নাম খোরপোশ বা খোরপোষ(খোরাক-পোষাকের খরচ) যা র্ফাসি শব্দ থেকে এসেছে।
আমরা সাধারনত ভরণ-পোষণ/ খোরপোষ (Maintenance) বলতে বিবাহের সময় বা বিবাহবিচ্ছেদের পরে স্বামী তাঁর স্ত্রীকে বাসস্থান, খাবার এবং পোশাকের জন্য প্রদেয় অর্থকে বলে থাকি। কিন্তু মুসলিম আইনে বিবাহ (Marriage), সম্পর্ক (Relationship), এবং সম্পত্তিগত (Property) কারণে এক ব্যক্তির ওপর অন্যব্যক্তির ভরণ-পোষণের দায়িত্ব আইনগতভাবে বর্তায়। যাহোক এ বিষয়ে পরে আলোচনা করা হবে। আজ স্ত্রীর ভরণ-পোষণ/খোরপোশ নিয়ে আলোচনা করবো।
ভরণ-পোষণ/খোরপোষ প্রসংগে সূরা আল-বাকারা(Al-Baqarah) এর ২৩৩ আয়াত এ স্ত্রীর ভরণ-পোষণের বিষয়টির সম্পর্কেও বলা হয়েছে “আর জননীগণ তাদের সন্তানদেরকে পূর্ণ দু’বছর স্তন্য পান করাবে, এটা তাঁর জন্য, যে স্তন্যপান কাল পূর্ণ করতে চায়। পিতার কর্তব্য যথাবিধি তাদের (সন্তানদের মায়েদের ) ভরণ-পোষণ করা।” এ আয়াতের মাধ্যমে এটা স্পষ্ট যে, শিশুকে স্তন্যদান করা মায়ের দায়িত্ব। আর শিশুর মায়ের অর্থাৎ স্ত্রী ভরণ-পোষণ ও জীবনধারণের অন্যান্য যাবতীয় খরচ বহন করা স্বামীর দায়িত্ব। এছাড়াও পবিত্র কুরআনের সূরা আত্ব-ত্বালাকের আয়াত-২ এ ভরণ-পোষণের বিষয়ে বলা হয়েছে।
The Status of Women under Islamic Law and Modern Islamic Legislation বইয়ে Nasir, J. J. A. বলেন,Maintenance involves the husband providing for his wife, at his own expense and according to his means, food, clothing, suitable housing with bathing facilities, toiletry necessities, and all medical fees and medicines that may be required.’’
স্বামী যখন স্ত্রীকে ভরণ-পোষণ দিতে বাধ্য(When husband is bound to give his wife maintenance)/স্ত্রীর ভরণপোষণের শর্ত(conditions of wife maintenance)
নিম্নলিখিত শর্ত সাপেক্ষে স্ত্রীকে ভরণ-পোষণ প্রদান স্বামীর দায়িত্ব।
ক. বিবাহটি আইনসম্মত হতে হবে;
খ. স্ত্রীকে স্বামীর এখতিয়ারে সোপর্দ করতে হবে;
গ. স্বামীর সম্মতিক্রমে স্ত্রী নিজের পিত্রালয়ে বা অন্য কোথাও অবস্থান করলে;
তাছাড়া নিম্নে বর্ণিত কারণে কোন স্ত্রী তার স্বামীর কাছ থেকে দূরে বসবাস করেও স্ত্রী ভরণপোষণ পেতে পারেন-
১. স্বামী যদি এমন কোন দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত থাকে যা সে স্ত্রীর কাছ থেকে পায় নি;
২. স্বামী যদি স্ত্রীর সঙ্গে বর্বর বা নিষ্ঠুর আচরণ করে এবং নিষ্ঠুরতা যদি এমন পর্যায়ে হয় যে স্বামীগৃহে তার জীবনাশংকার ভয় থাকে;
৩. অভ্যাসগতভাবে খারাপ ব্যবহার করে;
৪. গৃহত্যাগের নির্দেশ দেয়;
৫. তাড়িয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্র করে থাকে অথবা তাদের মধ্যেকার আচার আচরণ এরপ পর্যায়ে পৌঁছায় যে, এটা নিরসন করা সম্ভব নয় বা স্বামীর গৃহে থাকলে আরও অসুবিধা এবং বিরোধের জন্ম দিবে, সে অবস্থায় স্ত্রী স্বামীর সঙ্গে বসবাস না করেও খোরপোষ দাবি করতে পারে;
৬.সহবাস হোক বা না হোক, তলবি বা মুয়াজ্জেল দেনমোহর পরিশোধ না করার অথবা অন্য কোন আইনসঙ্গত কারণে স্ত্রী স্বামীর গৃহে বসবাস করতে অস্বীকার করলে;
৭.স্বামী আরেকটি বিয়ে করলে বা রক্ষিতা রাখলে স্ত্রী স্বামীর সাথে থাকতে অস্বীকৃতি জানাতে পারেন; কিংবা
৮. অন্যান্য যৌক্তিক কোন কারণ ।
কি কি কারণে স্বামী স্ত্রীকে ভরণপোষণ দিতে বাধ্য নন?
[Husband Not Liable to Pay Maintenance ]
নিম্নবর্ণিত কারণে কোন স্ত্রী তার স্বামীর কাছ থেকে ভরণপোষণ পাবেন না-
১. স্ত্রী স্বামীর নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও যেখানে স্বামী অবস্থান করে সেখানে ভিন্ন অন্যত্র বসবাস করলে ।
২. স্ত্রী বন্দিদশায় থাকলে(If wife has been Imprisoned)। তবে স্বামী বন্দিদশায় থাকলে স্ত্রী ভরণপোষণ হতে বঞ্চিত হবে না ।
৩. স্ত্রী অন্যায়ভাবে অবাধ্য হয়ে স্বামীর অনুমতি ছাড়া অসংগত কারণে স্বামীর
গৃহ ত্যাগ(conjugal domicile and her husband) করলে। স্বামীর অনুমতি
ছাড়া স্ত্রী অন্যত্র অবস্থান করে চাকরি বা জীবিকা নির্বাহের জন্য কোন কাজ
করলে;
৪. স্ত্রী কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়া স্বামীর সাথে বসবাস করতে অস্বীকার
করলে।
৫. স্ত্রী ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করলে [If A Wife Leaves Islam]।
৬. স্ত্রীর অবাধ্যাচারণে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটলে;
৭. স্বামীর মৃত্যুজনিত কারণে ইদ্দত পালনরত থাকলে; তবে শর্ত হলো যে,
বিধবা অন্তঃসত্তা হলে গর্ভ খালাস না অবধি খোরপোষ পাবে। স্বামীর
মৃত্যুর পর বিধাব স্ত্রী বতী হলে সন্তান প্রসব করা পর্যন্ত ভরণ-পোষণ
পাওয়ার অধিকারী হবে;
৮. স্ত্রীকে অপহরণ করে নিয়ে গেলে(If the wife is kidnapped)। কারণ
সেক্ষেত্রে স্বামীর পক্ষে স্ত্রী সম্ভোগের অবকাশ থাকে না;
৯. স্ত্রী ব্যভিচারিণী হলে(If the wife is adulterous);
১০. স্ত্রী পরিণত বয়স্ক না হলে;
১১.স্বামীর অনুমতি ছাড়া স্ত্রী হজ্জ পালন করতে গেলে।
বিবাহিত অবস্থায় স্ত্রীর ভরণ-পোষণ
[Maintenance of wife during the subsistence of marriage]
বিবাহের সম্পর্ক থাকাকালীন স্ত্রী স্বামীর কাছ থেকে ভরণ-পোষণ পাবে। তবে এর পরিমাণ নির্দিষ্ট করা হয়নি। স্বামীর আর্থিক অবস্থা অনুযায়ী ভরণ-পোষণ নির্ভর করে। The Dissolution of Muslim Marriages Act, 1939 এর ২(২) ধারার বিধান অনুযায়ী, স্বামী যদি তার স্ত্রীকে দুই বছর যাবৎ ভরণ-পোষণ প্রদানে ব্যর্থ হয়(that the husband has neglected or has failed to provide for her maintenance for a period of two years) তবে স্ত্রী বিবাহ ভঙ্গের ডিক্রী লাভের অধিকারিনী(Grounds for decree for dissolution of marriage) হবেন।
তালাকের পর ভরণ-পোষণ
[Maintenance after talaq]
তালাকের পর ইদ্দতের সময়কালে (৯০ দিন) স্ত্রী ভরণ-পোষণ পাওয়ার অধিকারী হয়। ইদ্দতের সময়কাল অতিবাহিত হবার পর তালাকের সংবাদ তাকে জানানো হলে, উক্ত সংবাদ তাকে না জানানো পর্যন্ত সে ভরণ-পোষণ দাবি করতে পারবে। তবে স্বামীর মৃত্যুর ফলে ইদ্দতের সময়কালে বিধবা ভরণ-পোষণ দাবি করতে পারবে না। এখানে Hefzur Rahman (Md) v Shamsun Nahar Begum and another 47 DLR (HCD) (1995) মামলায় হাইকোর্ট বিভাগ সিদ্ধান্ত তুলে ধরা উচিত, “স্বামীর অবশ্যই তার তালাক প্রদানকারী স্ত্রীকে এমনভাবে ভরণপোষণ দিতে হবে যা তার জন্য প্রয়োজন, এমনকি ইদ্দতকালীন সময় পার হওয়ার পরেও এই যথাযোগ্য ভরণপোষণ দিতে হবে একটি অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য যতদিন পর্যন্ত সেই তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীর অন্য কোনো বিয়ে না হয়”। কিন্তু হাইকোর্ট বিভাগের এই রায়কে দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ দ্বারা রহিত করা হয়। এই একই মামলায় আপিল বিভাগ শেষ পর্যন্ত বিবাহবিচ্ছেদের পর তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীকে কেবল তিন মাস (৯০ দিন) অর্থাৎ ইদ্দতকালীন সময় পর্যন্ত ভরণপোষণ দেয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
ভরণ-পোষণ আদায়ে স্ত্রীর আইনগত অধিকার
(Wife's legal rights for recovery of maintenance)
১। The Family Courts Ordinance, 1985 এর ৫(ঘ) ধারার অধীনে দেওয়ানি প্রতিকার পেতে (ভরণ-পোষণের জন্য) স্ত্রী সরাসরি পারিবারিক আদালতে মামলা দায়ের করে পারেন।
২। The Muslim Family Laws Ordinance, 1961এর ৯ ধারাতে বলা হয়েছে, স্বামী তার স্ত্রীকে ভরণ-পোষণ দিতে ব্যর্থ বলে স্ত্রী স্থানীয় চেয়ারম্যানের নিকট ভরণপোষণের জন্য আবেদন করবেন। চেয়ারম্যান সালিশি পরিষদ গঠন করে ভরণ-পোষণের পরিমাণ ঠিক করবেন এবং একটি সার্টিফিকেট ইস্যু করবেন।উল্লেখ্য, স্বামী/স্ত্রী নির্ধারিত পদ্ধতিতে, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নির্ধারিত ফি জমা দিয়ে ইস্যুকৃত সার্টিফিকেটটি পুনঃবিবেচনার উদ্দেশ্যে সহকারী জজের কাছে আবেদন করতে পারবেন এবং এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সহকারী জজের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত হবে। স্বামী এরপরও ভরণ-পোষণ না দিলে স্ত্রী বকেয়া ভূমি রাজস্বরূপে তা আদায় করতে পারবেন।
৩। The Dissolution of Muslim Marriages Act, 1939 এর ২(খ) ধারা অনুযায়ী স্বামী দুই বছর যাবৎ স্ত্রীর ভরণ-পোষণ প্রদানে অবহেলা প্রদর্শন করলে কিংবা ব্যর্থ হলে(husband has neglected or has failed to provide for her maintenance for a period of two years)স্ত্রী আদালতে বিবাহ-বিচ্ছেদের মামলা করতে পারে এবং একইভাবে স্বামীকে ভরণ-পোষণ প্রদানে বাধ্য করতে পারে।
Safura khatun v. Osman Gani Mollah, 9 (1957), DLR, 455 মামলায় বলা হয়েছিল যে, স্বামীর দেয়া ভরণপোষণ ছিল একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনার মতো। স্বামীর যে পরিমান ভরণপোষণ দেয়ার কথা ছিল, তার সামান্য পরিমান অর্থ স্বামী পরিশোধ করতো তাও আবার খুব অনিয়মিত। সুতরাং এক্ষেত্রে প্রতীয়মান হয় যে, উক্ত স্বামী কাবিননামার শর্ত পালন করেননি এবং এ কারনেই স্ত্রী তালাক-ই-তৌফিজের (তালাক-ই-তৌফিজ-স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে প্রদত্ত তালাক প্রদানের ক্ষমতা) ব্যবহার করে বিবাহ-বিচ্ছেদের আবেদন করতে পারেন।
এখানে একটি কথা তুলে ধরা উচিত যে, ভরণ-পোষণ নির্ধারণের ক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রী উভয়ের মান মর্যাদা ও সামর্থ্যের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে। পবিত্র কুরআনে সুরা তালাক : আয়াত ৭ এর নির্দেশ মতে, 'পুরুষ অভাবগ্রস্ত হলে তার সামর্থ্য অনুযায়ী ভরণ-পোষণ নির্ধারণ করতে হবে।' যদি বিবাহের কাবিননামায় ভরণ-পোষণের পরিমাণ উল্লেখ না থাকে, সেক্ষেত্রে আদালত ভরণ-পোষণের পরিমাণ নির্ধারণ করবে। ভরণ-পোষণ নির্ধারণের সময় আদালত স্বামীর ক্ষমতা, স্ত্রীর মর্যাদা ইত্যাদি বিবেচনা করবে। স্বামী যদি স্ত্রীর ভরণ-পোষণ প্রদান না করে প্রতারণার আশ্রয় নেয়, সেক্ষেত্রে স্ত্রী আদালতের শরনাপন্ন হতে পারেন। স্ত্রীর অভিযোগ প্রমাণিত হলে আদালত স্বামীকে ভরণ-পোষণ দানে বাধ্য করবেন।
0 Comments