বিবাহের শর্তাবলি কি কি?
Essential Conditions/requirements of a Valid muslim marriage
বিবাহ বা নিকাহ(Muslim marriage) এমন একটি চুক্তি যার উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য হলো বৈধভাবে সন্তান লাভ বা প্রতিপালন। Abdul Kadir v. Salima (1886) 8 All 149 মোকদ্দমার রায়ে বলা হয়েছে যে,' মুসলিম বিবাহ কেবল ধর্মীয় অনুষ্ঠান(sacrament) নয়, একটি বিশুদ্ধ দেওয়ানি চুক্তি(civil contract) যার উদ্দেশ্য পারিবারিক জীবনযাপন ও বৈধ সন্তান দান। মুসলিম পারিবারিক আইন এর অধীনে একটি আইনসম্মত নিকাহ/বিবাহ সম্পাদনের জন্য নিম্ন বর্ণিত বিষয়/শর্তগুলো অবশ্যই উপস্থিত থাকতে হবে:
১.পাত্র-পাত্রী নির্বাচন(Selection of spouses)
১৯৬১ সালে প্রণীত মুসলিম বিবাহ আইন অনুযায়ী, বিবাহ করতে ইচ্ছুক পক্ষদ্বয়কে অবশ্যই প্রাপ্তবয়স্ক-বয়স্কা এবং সুস্থ মস্তিষ্কের অধিকারী হতে হবে। এ ক্ষেত্রে পুরুষের বয়স ন্যূনতম ২১ বছর এবং স্ত্রীলোকের বয়স ন্যূনতম ১৮ বছর হতে হবে। বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন, ২০১৭ এর অধীনে বরের বয়স অবশ্যই ২১ বৎসর এবং কনের বয়স ১৮ বৎসর হতে হবে । সমাজের যে কোন চুক্তি সম্পাদনের জন্য যেমন দুই পক্ষকে প্রাপ্তবয়স্ক ও সুস্থ মস্তিস্কের অধিকারী হতে হয়, তেমনি বিয়ের চুক্তির ক্ষেত্রেও পক্ষদ্বয়কে প্রাপ্তবয়স্ক হতে হয়, অন্যথায় সাধারণ চুক্তির মতো এই চুক্তিও আইনসম্মত হবে না, বাতিলযোগ্য হবে।
২. সম্মতি/প্রস্তাব দান এবং কবুল(Proposal and Acceptance)
একটি বৈধ বিবাহ সম্পাদনের জন্য বর কনেকে ইজাব(ijab) বা বিবাহের প্রস্তাব করবে এবং কনে উক্ত প্রস্তাবটিতে নিজে সম্মতি প্রদান করে তা কবুল(qubul) বা গ্রহণ করতে হবে। বিয়ের ওয়ালী (অভিভাবক) এবং নারীর অনুমতি গ্রহণ প্রসঙ্গে বোখারী, মুসলিম, মিশকাত হাদিস/৩১২৬ বলা হয়েছে যে, বিবাহ করতে ইচ্ছুক পক্ষদ্বয়ের মধ্যে এক পক্ষকে প্রস্তাব দিতে হবে এবং অপর পক্ষ থেকে তা গ্রহণ করতে হবে। বিশেষভাবে নারীদের ক্ষেত্রে জোরপূর্বক বিয়েতে বাধ্য করা যাবে না; পক্ষগণের সম্মতির ব্যাপারে বলা হয়েছে যে, একটি পক্ষ প্রস্তাব করার পর অন্য পক্ষ কর্তৃক উহা স্বেচ্ছায় গ্রহণ করতে হবে এবং বৈধ বিবাহ সম্পাদনের ক্ষেত্রে এর গুরুত্ব অপরিসীম। কোন সুস্থ মস্তিস্ক ও প্রাপ্তবয়স্ক সম্পন্ন মুসলমানের বিয়ে যদি তার সম্মতি ব্যতিরেকে সম্পন্ন হয় তবে উক্ত বিবাহ চুক্তিটি বৈধ বিবাহ বলে গণ্য হবে না।
৩. দেনমোহর(mahr) বা মোহরানা নির্ধারণ(Consideration)
আল্লাহ তায়ালা বিবাহকে নারী-পুরুষের জন্য ফরজ করে দিয়েছেন, নারীর অর্থনৈতিক অধিকার সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে বিবাহ বন্ধনের সময় স্ত্রীর দেনমোহর আদায় করা পুরুষের জন্য ফরজ করে দিয়েছেন এবং বিবাহের সময়ই দেনমোহর আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন। বিবাহের সময় প্রাপ্য পুরো দেনমোহর আদায় করতে পুরুষ অপারগ হলে, দেনমোহরের একটা নির্দিষ্ট অংশ আদায় না করা পর্যন্ত বিবাহ বৈধ হবে না।
৪. দুজন ন্যায়নিষ্ঠ সাক্ষী(Witnesses) থাকা
প্রস্তাব দান ও গ্রহণ একই বৈঠক/মজলিসে কমপক্ষে দুজন প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন পুরুষ সাক্ষী কিংবা একজন পুরুষ ও দুজন মহিলা সাক্ষীর সামনে হতে হবে। তবে সাক্ষীগণকে একই বৈঠকে হাজির থাকতে হবে। একটি বৈধ বিবাহ সম্পাদনের ক্ষেত্রে সাক্ষীদের খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এই সাক্ষী সম্পর্কে হানাফি মত অনুসারে একজন পুরুষ ও দুজন মহিলার কথা বলা হয়েছে- একজন পুরুষকে একজন পূর্ণ সাক্ষ্য এবং সাক্ষী হিসেবে একজন নারীকে একজন পুরুষের অর্ধেক ধরা হয়েছে, অর্থাৎ একজন নারী সাক্ষীর সাক্ষ্য গুণ একজন পুরুষ সাক্ষীর সাক্ষ্য গুণের অর্ধেক। পবিত্র কুরআনে সূরা বাকারা-(২:২৮২ )Al-Baqarah(2:282) ঘোষণা করা হয়েছে যে, “এবং তোমাদের মধ্যে হতে দুইজন পুরুষ সাক্ষী ডেকে আন, কিন্তু যদি দুইজন পুরুষ সাক্ষী না পাওয়া যায়, তবে একজন পুরুষ বা দুইজন মহিলা”। কিন্তু বাংলাদেশের (সাক্ষ্য আইন) অনুযায়ী নারী ও পুরুষ সমান গুরুত্ব পেয়ে থাকেন। সুতরাং, বিয়ের সাক্ষী হিসেবে উপস্থিত দুই জনের দুই জন পুরুষ, দুই জন নারী অথবা একজন পুরুষ আর একজন নারী হতে পারে। বিয়ের প্রস্তাবটি সাক্ষীদের সামনে এমন ভাষায় প্রস্তাবিত হতে হবে যাতে করে উপস্থিত সবাই সেটা বুঝতে পারে যে এটা একটা বিবাহ চুক্তি সম্পাদন হচ্ছে।
৫. বিয়ের রেজিস্ট্রেশন(Registration) সম্পন্ন করা
১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইনের বিধান অনুসারে সরকার নিযুক্ত নিকাহ্ রেজিস্ট্রার দ্বারা অবশ্যই বিবাহ রেজিস্ট্রি করাতে হবে । যদিও বাংলাদেশের পারিবারিক আইনের আওতায় মুসলিমদের বেশিরভাগ গুরুত্বপূর্ণ পারিবারিক বিধান গুলো মুসলিম পারিবারিক আইন, অধ্যাদেশ, ১৯৬১ (Muslim Family Laws Ordinance, 1961) অনুসারে পরিচালিত হয়ে থাকে। কিন্তু বিবাহের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী মুসলিম বিবাহ ও তালাক(রেজিস্ট্রেশন) আইন, ১৯৭৪ [Muslim marriages and Divorces (Registration) Act, 1974] -এর বিধান অনুযায়ী হয়ে থাকে। মুসলিম আইন অনুযায়ী বিবাহ রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক করা। তবে বিবাহের দিন বা কোন কারণে তা সম্ভব না-হলে বিবাহের ৩০ দিনের মধ্যে নিবন্ধন সম্পন্ন করতে হবে। এক্ষেত্রে বিবাহ রেজিস্ট্রেশন না করা একটি শাস্তিযোগ্য(২ বৎসর বিনাশ্রম কারাদন্ড ও ৩০০০ টাকা জরিমানা বা উভয়দন্ড হতে পারে) অপরাধ। [The Muslim Marriages and Divorces (Registration) Act, 1974 এর ধারা-৫(৪)]
sources:
১। ইসলামে বিবাহের গুরুত্ব ও পদ্ধতিঃ http://imam.gov.bd/singlepost/4535(ইমাম বাতায়ন) ২। https://www.hadithbd.com/hadith/link/?id=68453
৩। ইসলামী আইনের ভাষ্য: গাজী শামছুর রহমান
৪। ইসলামিক জুরিসপ্রুডেন্স ও মুসলিম আইন: মোঃ মজিবুর রহমান ৫। ইসলামিক জুরিসপ্রুডেন্স ও মুসলিম আইন: এডভোকেট তফাজ্জল হোসেন
0 Comments