তল্লাশি(Search) কাকে বলে? তল্লাশির নিয়মাবলী/পদ্ধতি লিখুন বা তল্লাশির পূর্বে, তল্লাশির সময় ও তল্লাশির পরে করনীয় কি?
তল্লাশি(Search)
সাধারনত তল্লাশি অর্থ অন্বেষণ করা, খোঁজ করা, পরীক্ষা করা কিংবা সন্ধান করা ইত্যাদি। কিন্তু বাংলাদেশের প্রচলিত আইন যেমন ফৌজদারী কার্যবিধি আইনের ৯৬, ৯৮, ৯৯(ক), ১০০, ১০২, ১০৩, ১৬৫, ১৬৬ ধারা অনুযায়ী তল্লাশি পরোয়ানাসহ বা তল্লাশী পরোয়ানা ব্যতিত ক্ষমতাসম্পন্ন পুলিশ অফিসার বা ম্যাজিস্ট্রেট বা অন্য কোন ক্ষমতাসম্পন্ন অফিসার কর্তৃক কোন সন্দিগ্ধ বস্তু, জাল দলিল, জাল নোট, চোরাই মাল, অশ্লীল বই পুস্তক বা অপহৃত ও ভিকটিমকে উদ্ধারের জন্য কোন স্থানে (গৃহ বা আবদ্ধ স্থান, যানবাহন, অপরাধী বা সন্দেহভাজন ব্যক্তির দেহ বা প্রকাশ্য স্থানে) সাক্ষীর উপস্থিতিতে যে অনুসন্ধানমূলক অভিযান কার্যক্রম পরিচালিত তাকে তল্লাশি(Search) বলে।
অন্যভাবে বলা যায় যে, CrPC আইনের ৯৬, ৯৮, ৯৯(ক), ১০০, ১০২, ১০৩, ১৬৫, ১৬৬ ধারা এবং Police Regulation of Bengal এর প্রবিধান ২৮০ অনুযায়ী আদালত বা পুলিশ অফিসারের নিকট যদি প্রতীয়মান হয় যে কার্যবিধি আইন অনুসারে পরিচালিত কোন তদন্ত, অনুসন্ধান, বিচার বা অন্য কোন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় কোন দলিল,কোন মামলার আলামত, সন্দেহজনক বস্তু বা দ্রব্য কারও দখলে বা কোন স্থানে লুকায়িত আছে তবে উক্ত দলিল বস্তু বা দ্রব্য খুঁজে বের করার জন্য বা আটককৃত কোন ব্যক্তিকে উদ্ধার করার জন্য পরোয়ানাসহ বা পরোয়ানা ব্যতীত কোন স্থানে যে কার্যক্রম পরিচালনা করা হয় তাকে তল্লাশি(Search) বলে।
ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৭ ধারায়, যাকে গ্রেপ্তার করা হবে তিনি যে স্থানে প্রবেশ করেছেন সেই স্থান তল্লাশি, ৫১ ধারায় আটক ব্যক্তির দেহ তল্লাশি এবং ৫২ ধারায় মহিলাদের দেহ তল্লাশির নিয়ম বর্ণিত রয়েছে। এক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধির ৯৬ ধারার অধীনে ক্ষমতাসম্পন্ন আদালত তল্লাশি পরোয়ানা ইস্যু করলে দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৫ ধারার ক্ষমতাবলে তল্লাশি করে থাকেন।
তল্লাশি পরোয়ানা ইস্যু করার ক্ষমতা
বা কে তল্লাশি পরোয়ানা জারি করতে পারেন
১। ফৌজদারি কার্যবিধির ধারা ১৬, ১৮, ১৯ (ক), ১০০ মোতাবেক আদালত বা ম্যাজিস্ট্রেট তল্লাশি পরোয়ানা ইস্যু করতে পারেন। তাছাড়া জুয়া আইনের (The Public Gambling Act, 1867) ৫ ধারা, প্রাণিকল্যাণ আইন, ২০১৯ এর ১৩ ধারা এবং The Official Secrets Act, 1923 এর ১১ ধারা অনুযায়ী পুলিশ সুপার তল্লাশি পরোয়ানা ইস্যু করতে পারেন। ফৌজদারি কার্যবিধির ২৯৬(২) ধারাতে বলা আছে যে, পোস্টাল বা টেলিগ্রাফ কর্তৃপক্ষের হেফাজতে থাকা কোনো দলিল বা অন্য কোনো জিনিস তল্লাশির জন্য কেবল জেলা ম্যাজিস্ট্রেট পরোয়ানা ইস্যু করতে পারেন।
২। ফৌজদারি কার্যবিধি আইন ধারা-১৮, ১৯(ক) ১০০ ও ২৯৬, এবং স্থানীয় ও বিশেষ আইনেরবিধান অনুযায়ী তল্লাশি পরোয়ানা তামিলের জন্য পুলিশকে দায়িত্ব প্রদান করা যায়।
৩। ফৌজদারি কার্যবিধির ১৫৩, ১৬৫ ও ১৬৬ ধারাতে বর্ণিত রয়েছে যে, পরোয়ানা ছাড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও তদন্তকারী অফিসার তল্লাশি পরিচালনা করতে পারেন।
৪। ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬, ১৮, ১৯ (ক), ৪৭, ৪৮, ৪৯, ১০০, ১০২, ১৬৫ ধারা অনুযায়ী থানার ভারপ্রাপ্ত অফিসারের উপাধি বা পুলিশ অফিসারের নাম উল্লেখপূর্বক পরোয়ানা ইস্যু হলে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিজেই কার্যকর করতে পারেন অথবা অন্য কোনো অধস্তন অফিসারকে তামিলের জন্য অর্পণ করতে পারেন।
তল্লাশি কার্যক্রম পরিচালনার নিয়মাবলী
ফৌজদারী কার্যবিধি আইনের ৯৬, ৯৮, ৯৯(ক), ১০০, ১০২, ১০৩, ১৬৫, ১৬৬ ধারা এবং Police Regulation of Benga(পিআরবি) এর প্রবিধান ২৮০ অনুযায়ী মূলত তিনটি ধাপে (তল্লাশির পূর্বে, তল্লাশির সময়ে ও তল্লাশির পরে) তল্লাশি কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়ে থাকে। নিচে তল্লাশি কার্যক্রম পরিচালনার পদ্ধতি বা নিয়মাবলী আলোচনা করা হলো-
তল্লাশির পূর্বে করণীয় কার্যক্রম
১। ফৌজদারী কার্যবিধি আইনের ৯৬, ৯৮, ৯৯(ক) ও ১০০ ধারা অনুযায়ী পরোয়ানায় নির্দেশিত ব্যক্তি বা ফৌজদারী কার্যবিধির ১৬৫ ও ১৬৬ ধারা মোতাবেক থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা তদন্তকারী অফিসার বা লিখিত আদেশক্রমে অধঃস্তন কোন অফিসার তল্লাশি কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবেন।
২। ফৌজদারী কার্যবিধি আইনের ১৫৪, ১৫৫ ধারা, পিআরবি ৩৭৭ বিধির বিধান অনুযায়ী তল্লাশির কারণ জেনারেল ডায়েরি(General Diary) বা জিডিতে লিপিবদ্ধ করে থানা হতে বাহির হতে হবে।
৩। পিআরবির ১৪৫ প্রবিধান অনুযায়ী তল্লাশিকৃত স্থানের চারপাশে প্রয়োজনীয় ফৌর্স দিয়ে পাহারার ব্যবস্থা রাখতে হবে। অর্থাৎ ঘটনাস্থল এবং এর চারপাশ তল্লাশির সময় বাইরের একটি নির্দিষ্ট দিক থেকে শুরু করে ক্রমাগত চক্রাকারে ঘটনাস্থলটির কেন্দ্রস্থলে পৌঁছাতে হবে এবং সন্দেহজনক কিছু পাওয়া গেলে পুলিশ হেফাজতে নিতে হবে।
৪। ফৌজদারী কার্যবিধি আইনের ৯৬ ধারা এবং The Arms Act, 1878 এর ২৫ ধারা অনুযায়ী পরোয়ানাসহ তল্লাশির ক্ষেত্রে পরোয়ানার কপি সাথে নিতে হবে এবং বিনা পরোয়ানায় তল্লাশির ক্ষেত্রে মামলার এজাহার, কেস ডায়েরি ইত্যাদি উপযুক্ত প্রমান তল্লাশিকালে সাথে রাখতে হবে।
৫। ফৌজদারী কার্যবিধি আইনের ১০২(১) ও ১০৩(৩) ধারার বিধান অনুযায়ী যে স্থান/গৃহে তল্লাশি করতে হবে সেই স্থান/গৃহের মালিক/দখলদার/ প্রতিনিধিকে তল্লাশির সময় উপস্থিত থাকার অনুমতি নিতে হবে এবং তল্লাশিকালে তার বা তাদের সাহায্য নেওয়ার জন্য অনুরোধ করতে হবে। এক্ষেত্রে অনুরোধ না রাখলে অর্থাৎ অনুমতি না দিলে ফৌজদারী কার্যবিধির ৪৮ ধারার ক্ষমতা প্রয়োগ করে দরজা জানালা ভেঙ্গে প্রবেশ করতে হবে।
৬। পিআরবির ৯৫১ প্রবিধান অনুযায়ী সাধারণত ব্যতিক্রম ব্যতিরেকে পুলিশ সদস্যকে দায়িত্ব পালনকালে অফিশিয়াল পোশাক(উর্দি) পরিধান করতে হবে।
৭। ফৌজদারী কার্যবিধি আইনের ১০৩(১) ধারা এবং পিআরবির প্রবিধান ৪৬৫ অনুযায়ী তল্লাশির পূর্বে দুই বা ততোধিক সাক্ষীর উপস্থিতিতে তল্লাশি করতে হবে(Search to be made in presence of witnesses) এবং প্রয়োজনবোধে লিখিত আদেশ দিয়ে সাক্ষী তলব করা যাবে।
৮। পিআরবির প্রবিধান ২৮০(ঙ) অনুযায়ী সাধারনত তল্লাশি দিনের বেলায় পরিচালনা করা সবচেয়ে ভালো। প্রয়োজন থাকলে রাতেও তল্লাশি করা যাবে । এক্ষেত্রে ঘরের বাসিন্দা বিশেষ করে মহিলাদের কম কষ্ট দিয়ে তল্লাশি পরিচালনা করার নির্দেশনা রয়েছে।
৯। পিআরবির ২৮০(ঘ) প্রবিধান মোতাবেক তল্লাশির পূর্বে বাড়ির মালিক বা তার প্রতিনিধিদের সামনে স্থানীয় দুই বা ততোধিক সাক্ষীর দ্বারা তল্লাশি দলের (তদন্তকারী পুলিশ অফিসার, সাক্ষী ও খবর দাতা) দেহ তল্লাশি করে নিতে হবে।
তল্লাশির সময়ের করণীয় কার্যক্রম
১। ফৌজদারী কার্যবিধি আইনের ধারা ১০৩ (২), ১০৩ (৩) এবং পিআরবির ২৮০ প্রবিধান অনুযায়ী তল্লাশিকৃত স্থানের মালিক বা দখলদার বা প্রতিনিধি এবং সাক্ষীদের উপস্থিতিতে তল্লাশি কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে।
২। ফৌজদারী কার্যবিধি আইনের ১০২ (২) মোতাবেক তল্লাশিকৃত স্থানে প্রবেশের অনুমতি না পেলে বা প্রবেশ করতে না পারলে ফৌজদারী কার্যবিধির ৪৮ ধারা অনুসরণ করে উক্ত স্থানে তল্লাশি কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে।
৩। ফৌজদারী কার্যবিধি আইনের ৯৭ ধারা অনুযায়ী আদালত কর্তৃক তল্লাশি পরোয়ানাতে যে স্থানে তল্লাশি করতে আদেশ দেওয়া হয়েছে শুধুমাত্র সেই স্থানে তল্লাশি(Power to restrict warrant) করতে হবে।
৪। ফৌজদারী কার্যবিধির ১০২ (৩) ধারার বিধান অনুযায়ী তল্লাশিকালে যে বস্তু বা দ্রব্য উদ্ধারের জন্য তল্লাশী করা হয় উক্ত বস্তু কোন ব্যক্তির দেহে লুকায়িত আছে বলে সন্দেহ হলে ব্যক্তি পুরুষ হলে কার্যবিধির ৫১ ধারা এবং মহিলা হলে কার্যবিধির ৫২ ধারা অনুসরণ করে শালীনতার সাথে তল্লাশি পরিচালনা করতে হবে।
৫। ফৌজদারী কার্যবিধি ১০৩ (২) এর বিধান মতে তল্লাশির সময় প্রাপ্ত সকল মালামাল তল্লাশি তালিকা মোতাবেক সাক্ষীদের সাক্ষ্য গ্রহণপূর্বক হেফাজতে নিতে হবে ।
৬। পিআরবির প্রবিধান ২৮০ (ঙ) তে বলা আছে যে, মহিলার বাসস্থান বা শয়নঘরে তল্লাশি করা হলে শালীনতার প্রতি লক্ষ্য রেখে তল্লাশি পরিচালনা করতে হবে।
৭। তল্লাশিকালে সন্দেহভাজন বা ঘটনার সাথে জড়িত ব্যক্তি বা কারও দখলে বা দেহে লুকায়িত কোন মালামাল পাওয়া গেলে তাকে গ্রেফতার করে হেফাজতে নিতে হবে।
৮। তল্লাশির সময় কাউকে হয়রানি করা যাবে না- মর্মে পিআরবির প্রবিধান ২৬০ এ বলা আছে।
তল্লাশির পর করণীয় কার্যক্রম
১। ফৌজদারী কার্যবিধির ১৫৪, ১৫৫ ধারা এবং পিআরবি প্রবিধান ৩৭৭ ও ৩৭৯ মতে তল্লাশিকালে গৃহীত সকল কার্যক্রম অর্থাৎ যে সমস্ত মালামাল জিম্মা প্রদান করা হয় নাই সে সমস্ত মালামালসহ থানায় এসে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে অবহিত করে জিডি এন্ট্রি করতে হবে এবং সঙ্গে মালখানার রেজিস্টা্রে এন্ট্রি করে থানার মালখানায় জমা রাখতে হবে। প্রয়োজনে এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাতে হবে। (Crpc এর ১৫০ ধারা এবং পিআরবি ১২০ প্রবিধান)
২। ফৌজদারী কার্যবিধির ১০৩ (৩), ১০৩(৪) এবং পিআরবি প্রবিধান ২৮০ (ঞ) অনুসারে তল্লাশীকালে জব্দকৃত মালামালের একটি জব্দ তালিকা প্রস্তুত করতে হবে এবং কাউকে গ্রেফতার করা হলে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিসহ মালামাল আদালতে প্রেরণ করতে হবে।
৩। জব্দ তালিকার একটি কপি তল্লাশীকৃত স্থানের মালিক বা প্রতিনিধিকে প্রদান করতে হবে। যদি কোন মালামাল পাওয়া নাও যায় তদুপরি একটি জব্দ তালিকা প্রস্তুত করে তার একটি কপি প্রদান করতে হবে।
৪। ফৌজদারী কার্যবিধি আইনের ১০৩ (৫) অনুসারে তল্লাশীকালে লিখিত আদেশ দ্বারা তলব করা সত্ত্বেও কোন ব্যক্তি হাজির হতে বা সাক্ষী দিতে অস্বীকার করলে তার বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ১৮৭ ধারা মোতাবেক আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
৬। কার্যবিধি আইনের ১০৩(২) ধারা অনুযায়ী জব্দ তালিকা ছাড়া অন্য কোন মালামাল পুলিশ অফিসার নিয়েছে কিনা তার প্রস্তুতকৃত তালিকার গৃহের মালিকের এবং সাক্ষীদের দ্বারা স্বাক্ষরিত হবে।
৭। পিআরবির প্রবিধান ২৮০ মোতাবেক যদি কোন ভারী বস্তু পাওয়া যায় যা বহন করা অসম্ভব, এমন অবস্থায় সংশ্লিষ্ট এলাকার গণ্যমান্য কোন ব্যক্তির কাছ থেকে জিম্মানামা গ্রহণ করে জিম্মায় প্রদান করা যেতে পারে।
৮। পুলিশ আইনের ২৪ ধারা, পিআরবি ২১৩ প্রবিধান অনুযায়ী তল্লাশিকালে জব্দ তালিকার মূলকপি একটি প্রতিবেদনের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট এলাকার জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেটের আদালতে কোর্ট পুলিশ পরিদর্শকের মাধ্যমে প্রেরণ করতে হবে।
৯। পিআরবির প্রবিধান ২৮০ মতে তল্লাশিকালে জব্দকৃত(confiscated) মালামালের গায়ে সনাক্তকরণ লেবেল বা চিহ্ন লাগাতে হবে।
0 Comments