সর্বশেষ

6/recent/ticker-posts

আন্তর্জাতিক আইনের সংজ্ঞা দাও। অধ্যাপক ড.নুরুল ইসলাম বনাম রাষ্ট্র বাংলাদেশ সরকার এবং অন্যান্য (৫২ ডিএলআর ৪১৩) মামলার আলোকে বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক আইনের মর্যাদা ব্যাখ্যা কর।

 

আন্তর্জাতিক আইনের সংজ্ঞা দাও। অধ্যাপক ড.নুরুল ইসলাম বনাম রাষ্ট্র বাংলাদেশ সরকার এবং অন্যান্য (৫২ ডিএলআর ৪১৩) মামলার আলোকে বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক আইনের মর্যাদা ব্যাখ্যা কর।

(Define International Law. Explain the status of international law in Bangladesh with the reference to the Professor Dr. Nurul Islam Vs. Govt. of Bangladesh & others( 52 DLR 413) case.)

বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সংগঠনের সম্পর্ক কিভাবে নির্ণয় ও নিয়ন্ত্রিত হবে তা আন্তর্জাতিক আইনের আলোচনায় উঠে আসে। স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রসমূহের প্রতিনিধিদের সম্মতির ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক আইন প্রণীত হয় এবং রাষ্ট্রসমূহের সম্মতিতেই এর প্রতিফলন ঘটে। আর বিশ্বে শান্তি ও শৃঙ্খলার স্বার্থে এসকল রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক সুষ্ঠুভাবে নিয়ন্ত্রণের জন্য আন্তর্জাতিক আইনের সৃষ্টি হয়েছে। আন্তর্জাতিক আইন ও বহুপক্ষীয় চুক্তিগুলো সঠিকভাবে অনুসরণের মাধ্যমে একটি ন্যায্য বিশ্ব ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে। এরকম একটি বিশ্ব ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কোন স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের যদি সংশ্লিষ্ট কোন বিষয়ে বিধিবিধান নাও থাকে কিন্তু আন্তর্জাতিক কোন সংস্থার সদস্যপদ গ্রহণ করে থাকলে কিংবা কোন চুক্তিতে আবদ্ধ থাকলে ঐসব বিষয়ের ক্ষেত্রে 'সেফগার্ড' হিসেবে কাজ করে থাকে। 

আন্তর্জাতিক আইন:  পড়তে ক্লিক করুন


বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক আইনের মর্যাদা


অধ্যাপক ড.নুরুল ইসলাম বনাম রাষ্ট্র বাংলাদেশ সরকার এবং অন্যান্য (৫২ ডিএলআর ৪১৩) মামলার আলোকে বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক আইনের মর্যাদা নিয়ে আলোচনা করার আগে দেখতে হবে এই মামলার বিষয় কি ছিল। আলোচ্য মামলায় বাদী মানব স্বাস্থ্যের ওপর তামাকের প্রভাব প্রকাশের জন্য একটি বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ পর্যাপ্তভাবে কার্যকর করতে ব্যর্থতার দায়ে বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করেন। তিনি ধূমপানের কারণে মানব-জীবন ও স্বাস্থ্যের ঝুঁকির বিষয়ে অভিযোগ করেন এবং তামাক সেবনের কারণে পরিবেশ দূষিত হয় বলে দাবি করেন। বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী মানুষের জীবন ও স্বাধীনতার অধিকারের আহ্বান জানিয়ে রিটকারী তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপনকে অবৈধ ঘোষণার লক্ষ্যে আদালতের প্রতি আহ্বান জানান। আদালত তামাক বিজ্ঞাপনের দুটি মামলা একত্রিত করেছে। যাহোক, আসুন আমরা মামলার বিষয়টি সবিস্তারে দেখি:

মামলা:অধ্যাপক নুরুল ইসলাম ও অন্যান্য বনাম বাংলাদেশ সরকার ও অন্যান্য; Prof. Nurul Islam, et al. v. Government of the People’s Republic of Bangladesh, et al.( 52 D.L.R. 413):

মামলার ঘটনা: ১৯৯৯ সালে বিখ্যাত সিগারেট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানি (বাংলাদেশ) লিমিটেড তাদের উৎপাদিত ব্র্যান্ড 'গোল্ড লীফে'র এর প্রচার কার্যক্রম হিসেবে ‘ভয়েজ অব ডিসকভারি’কে বাংলাদেশে আমন্ত্রণ জানান। এই দেশে তরুণ প্রজন্ম এই প্রচার কার্যক্রমের ফলে ধূমপানের প্রতি আকৃষ্ট হতে পারে এই আশঙ্কায় বাংলাদেশের ধূমপানবিরোধী প্রখ্যাত সংস্থা ‘আমরা ধূমপান নিবারণ করি’(আধুনিক) এর সভাপতি জাতীয় অধ্যাপক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অধ্যাপক নুরুল ইসলাম হাইকোর্ট বিভাগে এই প্রচার কার্যক্রমের বিরুদ্ধে রিট পিটিশন দায়ের করেন। শুধু এই নির্দিষ্ট কার্যক্রমই নয়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিভিন্ন রিপোর্টে বর্ণিত ধূমপানের ক্ষতিকর দিক তুলে ধরে তামাকজাত দ্রব্যের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের অনুরোধ জানান।


তামাক কোম্পানিটি যুক্তি প্রদান করে যে, বাংলাদেশে তামাক সামগ্রী বিবরণ বিপণন নিয়ন্ত্রণ হয় ১৯৮৮ সালের ‘তামাক সামগ্রী বিপণন’ (নিয়ন্ত্রণ) আইনের মাধ্যমে। এই আইনে তামাক সামগ্রী প্রচার নিষিদ্ধ করা হয়নি, শুধু পণ্যের প্রচার সতর্কতামূলক বাণী উল্লেখের বিধান আছে, যা কোম্পানিটি মেনে চলছে। কোম্পানি পক্ষের আইনজীবী আরো যুক্তি দেখান যে, যদিও ১৯৯০ সালের ১৬ নম্বর অধ্যাদেশ দ্বারা তামাকজাত দ্রব্য সামগ্রিক প্রচার নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, তথাপি অধ্যাদেশটি যথাযথভাবে সংসদে উপস্থিত না হওয়ায় আইনের মর্যাদা হারিয়েছে। কাজেই, বাংলাদেশে বর্তমানে তামাক সামগ্রীর প্রচার নিষিদ্ধকারী কোন আইন নেই।


বিচার্য বিষয়: আদালত এতদসংক্রান্ত কোন নির্দিষ্ট আইনের অনুপস্থিতিতে ‘বয়েজ অব ডিসকভারী’র আগমনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারে কিনা?


মামলার রায়: এই মামলার রায়ে আদালত ‘বয়েজ অব ডিসকভারী’ র মাধ্যমে তামাক সামগ্রী প্রচার কার্যক্রমের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। কারণ হিসেবে আদালত যুক্তি দেখান যে, যদিও বাংলাদেশে তামাকজাত দ্রব্যের প্রচার নিষিদ্ধকরণে  কোন আইন নেই, তথাপি বাংলাদেশের কিছু আন্তর্জাতিক দায়বদ্ধতা আছে। বাংলাদেশ বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার সদস্য এবং এই সংস্থার ধূমপান বিরোধী কার্যক্রমের অংশীদার। বাংলাদেশে প্রতিবছর তামাকমুক্ত দিবস উদযাপন করে। এই সমস্ত বিষয় বিবেচনায় নিয়ে আদালত মত প্রকাশ করেন যে, বাংলাদেশের সংবিধানের ২৫(১) অনুচ্ছেদ অনুসারে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক আইন, জাতিসংঘ সনদের বিষয়াবলী এবং বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার তামাকজাত দ্রব্যের নিষিদ্ধকরণ সংক্রান্ত রেজুলেশন মানতে বাধ্য। অবশ্য আদালত ‘বয়েজ অব ডিসকভারী’ র মাধ্যমে প্রচারাভিযানের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলেও সামগ্রিক অর্থে তামাকজাত দ্রব্যের প্রচার নিষিদ্ধ করার আদেশ দেন নি, তবে এই বিষয়ে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য সরকারকে কিছু দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। [১]


বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘ অনুসৃত নীতি পালনে সাংবিধানিকভাবে বাধ্য। কেননা বাংলাদেশ সংবিধানের ২৫(১) এর অনুচ্ছেদে বলা আছে যে-

২৫৷ ২[***] জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও সমতার প্রতি শ্রদ্ধা, অন্যান্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা, আন্তর্জাতিক বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধান এবং আন্তর্জাতিক আইনের ও জাতিসংঘের সনদে বর্ণিত নীতিসমূহের প্রতি শ্রদ্ধা-এই সকল নীতি হইবে রাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভিত্তি এবং এই সকল নীতির ভিত্তিতে রাষ্ট্র-

(ক) আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে শক্তিপ্রয়োগ পরিহার এবং সাধারণ ও সম্পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণের জন্য চেষ্টা করিবেন;
(খ) প্রত্যেক জাতির স্বাধীন অভিপ্রায় অনুযায়ী পথ ও পন্থার মাধ্যমে অবাধে নিজস্ব সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা নির্ধারণ ও গঠনের অধিকার সমর্থন করিবেন; এবং
(গ) সাম্রাজ্যবাদ, ঔপনিবেশিকতাবাদ বা বর্ণবৈষম্যবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বের সর্বত্র নিপীড়িত জনগণের ন্যায়সঙ্গত সংগ্রামকে সমর্থন করিবেন ৷

মোটকথা, জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও সমতার প্রতি শ্রদ্ধা অন্যান্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা আন্তর্জাতিক বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ সমাধান এবং আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘ জাতিসংঘ বর্ণিত নীতি সমূহের প্রতি শ্রদ্ধা এইসকল নিতে হবে রাষ্ট্রীয় আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভিত্তি। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক দায়িত্বের সাথে রাষ্ট্রীয় আইনের সমন্বয় সাধনের বিধান সংবিধানে বর্ণিত রয়েছে। 

উপরোক্ত আলোচনা থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে সাংবিধানিকভাবে বাংলাদেশ সকল আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি মর্যাদা দিয়ে থাকে।



১. ড. মিজানুর রহমান,পরিবর্তনশীল বিশ্বে আন্তর্জাতিক আইন ,পুনর্মুদ্রণ (পলল প্রকাশনী,২০১২) ,২৪
২. সংবিধান (পঞ্চদশ সংশোধন) আইন, ২০১১ (২০১১ সনের ১৪নং আইন)-এর ১৫(ক) ও (খ) ধারাবলে (১) সংখ্যা ও বন্ধনী বিলুপ্ত এবং (২) দফা বিলুপ্ত।

 ........................

 

 

 

Post a Comment

0 Comments