ইসলাম ধর্মের বিশ্বাসীগণ অর্থাৎ মুসলমানগণের ব্যক্তিগত, আর্থ-সামাজিক ও ধর্মীয় তথা সমগ্র জীবনের সকল কার্যাবলীকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য পবিত্র কোরআন, হাদিস, ইজমা, কিয়াস ও সংশ্লিষ্ট নিয়ম নীতির আওতায় যে আইন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তাকে মুসলিম আইন বা ইসলামী আইন কিংবা শরীয়াহ আইন বলা হয়। এটি একটি পারিবারিক আইন যা কেবলমাত্র মুসলমানদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
বিশিষ্ট আইনবিজ্ঞানী Noel J. Coulson বলেন, “মহান আল্লাহতালার ইচ্ছার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রকাশে হলো মুসলিম বা ইসলামী আইন। এসব আইন মুসলিম সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং ইসলামী রাষ্ট্রের দিকনির্দেশক হিসেবেও কাজ করে।” ( Muslim law is the direct and indirect expression of the divine willingness of Allah which is the regulator of Islamic society and the Indicator of Islamic State.)[Source: A History of Islamic Law by Noel J. Coulson]
এখানে বলে রাখা ভালো যে, মুসলিম আইন কোন নির্দিষ্ট ভূ-খন্ডের সার্বভৌম রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা বা আইনসভা কিংবা ব্যক্তি বা সমাজ কর্তৃক গৃহীত কোন আইন নয় বরং এটি মহান আল্লাহর নিকট হতে প্রাপ্ত। এটি মূলত পবিত্র কোরআনে বিধৃত আল্লাহর হুকুমসমূহ (ইরম-উল-ইয়াকিন) এবং মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা:)কর্তৃক নির্দেশিত পথ।
মুসলিম আইনের উৎসসমূহ(Sources of Muslim law/Islamic law)
মুসলিম আইনের উৎসসমূহ কে প্রধানত তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন-
১। আনুষ্ঠানিক বা মূল উৎস (Formal or original source):আল কুরআন,সুন্নাহ বা হাদিস,ইজমা ও কিয়াস।
২। সম্পূরক উৎস(Supplementary source):ইসতিহসান, ইসতিসলাহ, ইসতিদলাল ও ইজতিহাদ ।
৩। ব্যবহারিক বা বস্তুগত উৎস(Practical or material source): প্রথা বা উরফ,নজীর বা পূর্বদৃষ্টান্ত ।
আনুষ্ঠানিক বা মূল উৎস (Official or original source)
মুসলিম আইন এর আনুষ্ঠানিক মূল উৎস হল আবার চার ভাগে ভাগ করা যায়। এবার এগুলো আলোচনার মাধ্যমে নিচে তুলে ধরা হলো ।
১।পবিত্র কুরআন শরিফ(The Holy Quran)
কুরআন মজিদ বা কুরআ-ন মাজী-দ বা কোরআন মুসলিম আইনের মূল, সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও নির্ভরযোগ্য উৎস। মুসলমানরা বিশ্বাস করেন যে ,এই কিতাব হযরত জিব্রাইল আলাই সাল্লাম এর মাধ্যমে বিশেষ বিশেষ মুহূর্তে প্রাপ্ত এবং হযরত মুহাম্মদ (সা:) কর্তৃক উচ্চারিত আল্লাহর বাণীসমূহের সংকলন। পবিত্র কোরআনের ২০০ টি আয়াতের মাধ্যমে মুসলিম আইনের সাধারণ নীতিমালা ফুটে উঠেছে এবং বিভিন্ন অপরাধের বিষয়ে হুঁশিয়ারি করা হয়েছে এবং শাস্তির বিধানও বর্ণিত রয়েছে। মোটকথা বাস্তব ভিত্তিক আইনের যাবতীয় বিধি বিধানই পবিত্র কোরআনে বলা আছে।
২।সুন্নাহ বা হাদিস(The Sunnah/The Hadiths)
ইসলামী আইনে আল-কোরআনের পরেই নির্ভরযোগ্য উৎস হচ্ছে সুন্নাহ বা হাদিস যা মূলত ইসলামের শেষ বাণীবাহক,হযরত মুহাম্মদ (সা:) এর বাণী,নির্দেশনাবলী ও জীবনাচরণ। হাদিসে বর্ণিত উপদেশ মুসলমানদের জীবনাচরণ ও ব্যবহারবিধির অন্যতম পথনির্দেশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাই বলা হয়,কুরআন ইসলামের মৌলিক গ্রন্থ এবং হাদিসকে অনেক সময় তার ব্যাখ্যা হিসেবেও অভিহিত করা হয়।
৩। ইজমা(Al Izma)
আরবি শব্দ, ইজমা মানে কোন বিষয়ে একমত পোষণ করা। শরীয়তের ভাষায়, কোন কাজ বা কথার ওপর এক যুগের উম্মতে মোহাম্মদীর ন্যায়বান মুজাহিদগণের ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্তই হলো ইজমা।এক কথায় বলা যায় রাসূল (সাঃ) এর সঙ্গী ও তার শিষ্যগণের মধ্যকার মতানৈক্য নামই হলো ইজমা। ইজমা মূলত মুসলমান ফকিহ ও ওলামাগনের ঐক্যমতের উপর প্রতিষ্ঠিত। ইজমার মাধ্যমে কোন বিশেষ যুগের আইন সংক্রান্ত কোনো বিশেষ প্রশ্নের বা সমস্যার সমাধান কোরআন ও হাদিসকে কেন্দ্র করে মুসলিম পণ্ডিতগণ সম্মিলিত অভিমত পোষণ করে থাকেন। ইজমার গুরুত্ব দেখতে পাওয়া যায় কুরআন কারীমের ৪ সূরাঃ আন-নিসা | An-Nisa | سورة النساء - আয়াতঃ ১১৫তে “আর কারো নিকট সৎ পথ প্রকাশিত হওয়ার পর সে যদি রাসূল (সাঃ) এর বিরুদ্ধাচরণ করে এবং মুমিনদের(বিশ্বাসীগণ) পথ ভিন্ন অন্য কোনো পথ অনুসরণ করে, তবে যেদিকে সে ফিরে যায় সে দিকেই তাকে আমরা ফিরিয়ে দেব এবং তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ বা দগ্ধ করবো, আর তা কতই না মন্দ আবাস!”
৪। কিয়াস (Qiyas)
মুসলিম আইনশাস্ত্রের চতুর্থ উৎস হিসেবে কিয়াস (Qiyas) এর অবস্থান। কোন সমস্যার সমাধানে যখন কুরআন, সুন্নাহ ও ইজমাতে সরাসরি কোন নির্দেশনা পাওয়া না যায় তখন ইসলামী পন্ডিতগণ কিয়াসের মাধ্যমে কোরআন ও হাদিসের মধ্যে প্রদত্ত অনুরূপ সমস্যার সমাধান কে ভিত্তি করে যুক্তি প্রয়োগে মাসয়ালা বা বিধান উৎসভিত্তিক অনুমান করে উদ্ভূত সমস্যার সমাধান করে থাকেন। কিয়াসকে ইসলামী আইন বিজ্ঞানের এক গতিশীল বলা হয়।
ইমাম আবু হানিফা (রঃ) বলেন, “কিয়াস হলো আইনের বিস্তৃতি। মূল আইন যখন সমস্যার সমাধানে যথেষ্ট না হয়, তখন মূল আইন হতে ইল্লাতের দ্বারা নতুন আইন-বিধি আহরণ করতে হয়। আর তখন যে আইনের সম্প্রসারণ হয় তাকেই বলা হয় কিয়াস।” কিসের মাধ্যমে সাহাবী, তাবিঈ ও তাবি-তাবিঈগণ শরীয়তের বহু নতুন নতুন প্রশ্ন বা সমস্যা সমাধান দিয়েছেন। এটি কুরআন ও হাদীসের সমতুল্য নয় বরং সামঞ্জস্যপূর্ণ বিধান।
মুসলিম আইনের সম্পূরক উৎস(Supplementary source):
১। ইসতিহসান(Istihsan)
ইসতিহসান মানে সমর্থন বা অনুমোদন। যখন কোন নির্দিষ্ট সমস্যার ক্ষেত্রে একাধিক সমাধান থাকে, তখন ইসলামী আইন বিশেষজ্ঞগণ সর্বাধিক গ্রহণীয় যে সমাধান নিয়ে থাকেন তার নামই ইসতিহসান। এটি ইমাম আবু হানিফা (র.) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত।
২। ইসতিসলাহ(Istislah)
ইসতিসলাহ হল জনস্বার্থমূলক আইন। এই ধরনের আইনের মূল কথা হলো যা জনকল্যাণমূলক তাই গ্রহণযোগ্য। সাধারণ মানুষের সর্বোচ্চ স্বার্থ রক্ষার্থে ফকিহগণ তাদের প্রজ্ঞা ব্যবহার করে থাকেন। ইমাম মালেক (র) ইসতিসলাহ এর প্রবর্তক। ‘প্রাকৃতিক আইন’ এর সাথে ইসতিসলাহের কিছুটা মিল রয়েছে।বর্তমানে ইসতিসলাহের পদ্ধতি মিশরের সুপ্রিম সাংবিধানিক আদালত দ্বারা সমর্থিত হয়েছে। কিন্তু এই উৎসটি শাফেয়ী, হাম্বলী এমনকি জাহিরি মাজহাবের মানুষেরাও অস্বীকার করেন।
৩। ইসতিদলাল(Istidlal) বা ইসতিসাব
৪। ইজতিহাদ (Ijtihad)
ইজতিহাদ মানে কোন বিষয়ে জানার চূড়ান্ত প্রয়াস কিংবা যথাসাধ্য সর্বাত্তক প্রচেষ্টা করা। ইসলামী কোন বিষয়ে উলামাদের গবেষণার নামই ইজতিহাদ। যারা ইজতিহাদ করে তাদেরকে মুজতাহিদ বলা হয়। ইসলামি আইনে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে মুজতাহিদগণ কুরআন, হাদিস ও অন্যান্য গবেষণালব্ধ জ্ঞান ব্যবহার করে তার মতামত দিয়ে থাকেন। এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয় যে তাকলীদের [পূর্বের কোন সিদ্ধান্ত অন্ধভাবে গ্রহণ করা] অন্ধ অনুকরণ বা অনুসরণ না করে যুক্তি পরামর্শের মাধ্যমে কুরআন সুন্নাহর সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা ও সম্প্রসারণ করে উদ্ভূত সমস্যার সমাধান করার নামই ইজতিহাদ। অনেক ইসলামী ফিকাহবিদ মনে করেন যে, ইজতিহাদের বিভিন্ন রূপ হচ্ছে ইসতিইসলা,ইসতিহাব ইত্যাদি।
ব্যবহারিক বা বস্তুগত উৎস(Material source):
১। প্রচলিত প্রথা বা উরফ/Urf (Customary Law)
ইসলামী আইনবিদ্গণ (ফকীহগণ) অনেক মাসআলার বিধান উদ্ভাবনে ইসলামী সমাজের প্রথা বা উরফের ওপর নির্ভর করে থাকেন। প্রাক ইসলামী যুগে প্রাথমিক সমাজ ব্যবস্থার যেসব কল্যাণকর রেওয়াজ যা কুরআন-সুন্নাহ কর্তৃক গৃহীত হয়েছে সেগুলোকে প্রথা বা উরফ(প্রচলিত উত্তম কথা ও কাজ) বলা হয়। অনেকেই আবার আদাত( প্রচলিত উত্তম রীতিনীতি) কে উরফের সমার্থক হিসেবে ইসলামী আইনের উৎস হিসেবে গণ্য করে।
প্রাক ইসলামী যুগে যিহার(নিজের স্ত্রীকে মায়ের সাথে তুলনা করা), ইলা(স্বামী তার স্ত্রীর সাথে সহবাস না করার শপথ), খুলা(নির্দিষ্ট শব্দ ব্যবহারের মাধ্যমে ক্ষতিপূরণ নিয়ে বিবাহ বিচ্ছেদ) ইত্যাদি প্রথার মাধ্যমে বিবাহ বিচ্ছেদ বা তালাক কার্যকর হতো। এরূপ কোন তালাকপ্রাপ্ত নারী পুনরায় বিবাহ করতে চাইলে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করার রেওয়াজ ছিল যা ইসলামী পরিভাষায় ইদ্দত পালন বলে। এরকম ইদ্দত পালনের বিধান ইসলামী আইনে ও দেখতে পাওয়া যায়।
২। নজীর বা পূর্বদৃষ্টান্ত (Precedent)
লেখার উৎসসমূহ:
১. Mahomedan Law (মুসলমানী আইন) অনুবাদক-প্রফেসর ড. এটিএম কামরুল ইসলাম
২. ইসলামী আইনের উৎস(Sources Of Islamic Law), মুহাম্মদ রুহুল আমিন,বাংলাদেশ ইসলামিক ল’রিসার্চ এন্ড লিগ্যাল এইড সেন্টার।
৩. Textbook on Muslim Law, Rakesh Kumar Singh
৪. ইসলামী আইন,মেহেদী হাসান , বাংলাদেশ ইসলামিক ল’রিসার্চ এন্ড লিগ্যাল এইড সেন্টার।
৫. মুসলিম আইনের মূলনীতি,by D. F. Mulla, বাংলায় অনুবাদকৃত বই
৬. মুসলিম আইন - গওছুল আলম,বাংলা একাডেমি
৭. http://www.jiwaji.edu/pdf/ecourse/law/Sources%20of%20law.pdf
৮. Asaf A.A Fyzee, Outlines of Muhammadan Law, edited and revised by Tahir Mahmood, 5th edition, 2008, Oxford India Paperback. (Classic).
৯. Dr. Paras Diwan, Law of Marriage and Divorce, seventh edition, 2016 Allahabad Law Agency. (Classic).
১০.http://mja.gov.in/Site/Upload/GR/Title%20NO.149(As%20Per%20Workshop%20List%20title%20no149%20pdf).pdf
১১. https://dictionary.cambridge.org/dictionary/english/legislation
১২.https://www.mondaq.com/india/trials-appeals-compensation/882616/judicial-precedents-in-india
১৩.https://www.lawteacher.net/lecture-notes/judicial-precedent-1.php
১৪. https://www.tribuneindia.com/news/schools/legislation-as-a-source-of-law-143948
১৫. https://old.amu.ac.in/emp/studym/100001747.pdf.
১৬. http://www.legalserviceindia.com/article/l302-Sources-of-Islamic-Law.html
0 Comments